এইডস ও মাদকাসক্তি পরিস্থিতি প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

এইডস ও মাদকাসক্তি পরিস্থিতি প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী
এইডস হলো এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) থেকে সৃষ্ট একটি ভয়াবহ রোগ। এটি প্রতিরোধ যোগ্য মরণব্যাধি। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। বর্তমানে এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৪৯। বিশ্বে প্রতিদিন ৪ হাজার মানুষ এইচআইভি এইডসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং বিশ্বে প্রতি মিনিটে চার জন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এর মধ্যে মারা যাচ্ছে এক জন। এইচআইভি এইডসের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর দিনটিকে ডড়ৎষফ অওউঝ উধু হিসেবে পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো :‘খবঃ ঈড়সসঁহরঃরবং খবধফ’।
এইচআইভি এইডস জন্মগত বা ছোঁয়াচে রোগ নয়। যে কোনো ব্যক্তিই (বিশেষ করে তরুণ, যুবসমাজ) এইচআইভি সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিতে থাকে। এইচআইভি বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকে। যেমন: আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন থেকে হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তগ্রহণ, আক্রান্ত মা থেকে তার শিশুতে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহূত সিরিঞ্জ অন্যজন ব্যবহারের মাধ্যমেও এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে।
এইচআইভি একটি অতি ক্ষুদ্র জীবাণু, যা মানবদেহে প্রবেশ করে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ফলে আক্রান্ত মানুষের শরীরে এক বা একাধিক রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। এ রোগের লক্ষণ পেতে কয়েক মাস থেকে ১০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এ রোগের উপসর্গ হিসেবে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে জ্বর, গলাব্যথা, শরীরের চামড়ায় দাগ দেখা দেয়। অনেকের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর্যন্ত কোনো উপসর্গ না-ও থাকতে পারে।
জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের ২০২১ সালের তথ্যনুযায়ী বাংলাদেশে এই রোগের আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার। এর মধ্যে চিকিৎসার আওতায় এসেছে ৮৪ শতাংশ। ২০২০ সালে দেশে এইডস আক্রান্ত হয়ে ২০৫ জন মৃত্যুবরণ করে। এযাবৎ প্রায় ২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এইডসের কারণে। সংখ্যার দিক থেকে আক্রান্ত বা মৃতের পরিমাণ কম মনে হলেও এইচআইভি এইডসের ঝুঁকি নেহাত কম নয়। কারণ সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। মাদকসেবী এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দেশে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে, যা উদ্বেগজনক! উপরন্তু আতঙ্কের বিষয় হলো-আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার এইডস রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে এ দেশের ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন শ্রেণির সাধারণ মানুষের যোগাযোগ আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী-২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৬৯ জনের এইচআইভি/এইডস শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৫৮৯।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারীই এইডস বিষয়ে অবগত নন। এক্ষেত্রে সচেতনতার হার বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক। এটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ায়। সুতরাং আমাদের দেহে স্পটভিত্তিক ট্রান্সমিশন বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশে অনেক সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। তার মধ্যে মাদকাসক্তি বড় একটি সমস্যা এবং এটি বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তামাকসেবন মানুষের অকালমৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বেসরকারি হিসেব মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন রোগের মতো এইচআইভি এইডসের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদক গ্রহণকালীন অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করেন, যেমন-অনিরাপদ ও একাধিক যৌন সম্পর্ক, সুঁই/সিরিঞ্জের শেয়ার করে মাদকগ্রহণ ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন রোগের মতো মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তিরা এইডসের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত এইচআইভি এইডসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে, যারা সুঁই ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে।
মনে রাখতে হবে, মাদকের ভয়াবহতা কমাতে না পারলে দেশের অনেক সমস্যাকে উসকে দিতে পারে; তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-এইচআইভি এইডস। কেননা, তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তির সংখ্যা বেশি এবং এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী মানুষ বাড়ছে। মাদকাসক্তির মতো বড় সামাজিক সমস্যা রুখতে এবং প্রাণঘাতী রোগ এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো অত্যাবশ্যক। এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে বৈষম্য রুখতে জাতীয় আইন/নীতির বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। এছাড়া এইচআইভি সংক্রমণ রুখতে দেশের অন্তত সব সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে, বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও স্থলবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। সর্বোপরি, মানুষ সচেতন না হলে এই ঝুঁকি এড়ানো কঠিন।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *