অসহায়ের সহায় মাতৃছায়া

অসহায়ের সহায় মাতৃছায়া

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: কেউ পড়েছিলেন হাসপাতালের বারান্দায়, কেউবা বাস বা রেলস্টেশনে। ‘ঠিকানাহীন’ এমন ১৯ জন নারী-পুরুষের ঠিকানা এখন মাতৃছায়া সমাজ কল্যাণ সংস্থা ও বৃদ্ধাশ্রম। এর অবস্থান ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বীর বেতাগৈর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত বীরকামাটখালী গ্রামে। অন্যান্য বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে এর তফাৎ হলো-এখানে সপরিবারে বসবাস করেন আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম। শুধু তাঁরা থাকেনই না, খানও একই সঙ্গে একই পাকে রান্না করা খাবার।
প্রায় ১৫ বছর ধরে স্ত্রী, তিন সন্তানসহ এই ২৪ সদস্যের পরিবারের লালন-পালনের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন রফিকুল ইসলাম। স্থানীয়দের কাছে তিনি মানবিক রফিকুল হিসেবেই পরিচিত। এখানে যাঁরা থাকেন তাঁদের কেউ কথা বলতে পারেন না, কেউবা হাঁটাচলায় অক্ষম, কেউ চোখে দেখেন না, কারো আবার মানসিক সমস্যা। কারো স্বামী নেই, কারো স্ত্রী। কারো আবার নেই কোনো পুত্র সন্তান। কারো আবার সন্তান থেকেও যেন নেই! আদতে তাঁদের পরিবারের কোনো খোঁজ নেই। তাঁদের কেউ পরিত্যক্ত, দুর্ভাগ্যক্রমে কেউবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। একেকজনের জীবনের গল্প একেক রকম। তবে এক জায়গায় মিল-জীবনে জুটেছে অনাদর, অবহেলা। এসব মানুষের জন্য অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আশ্রমটি গড়ে তুলেছেন রফিকুল ইসলাম।
আগে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন রফিকুল। চাকরি করতেন মাস্টাররোলে। প্রায়ই দেখতেন হাসপাতালের বারান্দায় বা জরুরি বিভাগের সামনে পড়ে আছেন অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। দেখে মায়া লাগত। তখন ২০০৮ সাল। বেশ কিছুদিন ধরে দেখছিলেন এক বৃদ্ধা পড়ে আছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে। রফিকুল একদিন সেই বৃদ্ধাকে রুটি-কলা কিনে দিলেন। আরেক দিন দিলেন ভাত। পরে নিয়মিত তিন বেলা খাবার দিলেন। এভাবে একসময় সেই বৃদ্ধার মায়ায় পড়ে গেলেন মাহারা রফিকুল। একসময় মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার জাকিরের সঙ্গে আলাপ করলেন। বললেন, ‘স্যার, মানুষগুলোকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে খারাপ লাগে। আপনারা যদি একটু সাহায্য করেন তাহলে উনাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা করতে চাই।’ শুনে সেই চিকিৎসক বললেন, ‘তুমি যদি লালন-পালন করতে পার, তাহলে আমরা সাহায্য করব।’
মাসখানেক চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হলে স্ত্রীকে বুঝিয়ে সেই নারীকে নিয়ে এলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। স্ত্রীর কাছে রেখে আবার চলে যান কর্মস্থলে। কল্পনা আক্তারের সেবা শুশ্রূষায় ভালো হতে থাকেন হোসনা নামের বৃদ্ধা। ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে রফিকুল জানলেন, সেই নারীর মেয়ে বাসাবাড়িতে আয়ার কাজ করেন। মাস দুয়েক পর ৮০ বছর বয়সী সেই বৃদ্ধা মাকে তুলে দিলেন মেয়ের হাতে।

তাঁদেরও ঠাঁই বৃদ্ধাশ্রমে
কিছুদিন পর হাসপাতালের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে পড়ে থাকতে দেখলেন এক বৃদ্ধাকে। ভানুমতি নামের সেই বৃদ্ধাকে হাসপাতালে রেখে গেছেন স্বজনরা। রফিকুল তাঁকেও নিয়ে এলেন বাড়িতে। সেবাযতœ করলেন। স্ত্রীকে বললেন, ‘হাসপাতালে এমন অনেককে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আমার মা-বাবা থাকলে তো তাঁদের এভাবে রাখতাম না। এখন অসহায় এই মানুষগুলোর জন্য বৃদ্ধাশ্রম করতে চাই।’ কল্পনা বললেন, ‘বেশি লোকরে তো খাওয়াইতে পারব না। অল্প লোক হইলে ভালো। এলাকাবাসীর লগেও আলাপ করা দরকার।’
পরে বিষয়টি নিয়ে রফিকুল আলাপ করলেন এলাকাবাসীর সঙ্গে। এক বৈঠকে সবাই সাধ্যমতো রফিকুলের পাশে থাকবেন বলে জানালেন। ২০০৯ সালে এভাবে শুরু হলো মাতৃচ্ছায়া বৃদ্ধাশ্রমের। প্রথমে নিজের বসতঘরের পাশেই কয়েকটি টিন দিয়ে চালা তৈরি করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। তাঁদের দেখতে প্রায়ই রফিকুল চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে। মানুষগুলোর কষ্ট দেখে শৈশবে মা-বাবা হারানো রফিকুলের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এই বয়সী মানুষগুলোর নিয়মিত সেবাযতœ দরকার। তাই স্থায়ীভাবে তাঁদের পাশে থাকার জন্য একসময় চাকরিও ছেড়ে দেন। চলে আসেন বাড়িতে। ময়মনসিংহ শহরে থাকা নিজের দুই শতাংশ জমিও বিক্রি করেন সাড়ে চার লাখ টাকায়। সেই টাকায় গ্রামে আট শতাংশ জমি কিনে গড়ে তুললেন বৃদ্ধাশ্রম।
শুরুতে এখানে আশ্রয় পেয়েছিলেন তিনজন নারী। এখন আছেন ১৭ জন নারী ও দুজন পুরুষ। এই আশ্রয়হীন মানুষগুলোকে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেরাই হয়ে পড়েন সম্বলহীন। বৃদ্ধাশ্রমটি চালাতে গিয়ে পরে নিজের শেষ সম্বল ২০ শতাংশ জমিও বিক্রি করতে হয়েছে রফিকুলকে। শেষে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি উঠে আসেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। বসবাস শুরু করেন জীবনের পড়ন্ত বেলায় থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে।
রফিকুল বলেন, ‘আমি জেনেবুঝেই এ কাজে হাত দিয়েছি। আমার মা-বাবা বেঁচে নেই। এখন তাঁরাই আমার মা-বাবা।’ তাঁর স্ত্রী কল্পনা আক্তার জানান, শুরুর দিকে খারাপ লাগত। মনে হতো, তিনি পাগলামি করছেন। কিন্তু এখন মনে হয় আমরা ঠিক পথেই আছি। আমি তিন সন্তানের জননী। ছেলেটা এবার এইচএসসি দিয়েছে। মেয়ে দুটো আমাদের সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। ওদেরকেও মানবিক শিক্ষা দিচ্ছি।’
আয়েশা বেগম ও রেজিয়া বেগম নামের দুজন কল্পনাকে নানা কাজে সহযোগিতা করেন। এখানে শুরু থেকেই থাকা নান্দাইলের খারুয়া ইউনিয়নের রেজিয়া বেগমের মা-বাবা কেউ নেই। স্বামীও তাঁকে রেখে চলে গেছেন। কল্পনা আক্তারকে মা বলে ডাকেন। আয়েশার গল্পটাও একই রকম। তিনি বললেন, ‘এখানে থাকি, খাই। অন্যদের সাহায্য করি।’
সরেজমিনে
বাড়িটি সব সময় বয়স্কদের কোলাহলে মুখরিত থাকে। প্রতিদিন তিনবেলা রান্না চলে এখানে। রফিকুলের স্ত্রী কল্পনা আক্তার নিজেই রান্না করেন। দুই মেয়ে আর এক পরিচারিকা তাঁকে সাহায্য করে। রান্না শেষে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেন। কয়েকজন নিজে নিজে খেতে পারেন না। তাঁদের খাইয়ে দেন রফিকুল ও কল্পনা। কল্পনা বললেন, ‘এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যখন দুটো খেতে পান, একটু ভালো থাকেন দেখে আমার খুব আনন্দ লাগে।’
গত বছর মাতৃচ্ছায়া বৃদ্ধাশ্রমে একটি ঘর তুলে দিয়েছেন এপেক্স ক্লাব অব ময়মনসিংহ নামের একটি সংগঠন। দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরটিতে থাকছেন এই ১৯ জন। দুটো করে বাথরুম ও গোসলখানাও আছে। খাবার জিনিপত্র রাখা ও নামাজের জন্য আলাদা ঘর আছে।
গত বুধবার সকালে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সবাইকে সকালের নাশতা দেওয়া হয়েছে। ভাত, ডাল ও আলু ভাজি। কোনো কোনো দিন দেওয়া হয় আটার রুটি ও সবজি। নাশতার পরপরই গোসলের জন্য সবাইকে তৈরি হতে বলছেন রফিকুল ও কল্পনা। এই ফাঁকে রফিকুল আর কল্পনা পোশাক বদল করে নিলেন। কারণ, আশ্রিতদের অনেকের গোসল করার মতো সামর্থ্য নেই। তাঁদের গোসল করিয়ে দিতে হবে। পরে রফিকুল প্রতিবন্ধী এক বৃদ্ধকে বিছানা থেকে ধরে গোসলখানায় নিয়ে গেলেন। কল্পনা এক বৃদ্ধার গায়ে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। গোসল শেষে তোয়ালে দিয়ে গা মুছে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। পরে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি জানালেন, তরকারি কুটে রেখেছি। এখন রান্না বসাব। আজ থাকছে ছোট মাছ, আলু ভর্তা আর ডাল। সপ্তাহে দুই দিন মাংস দেওয়া হয়। এর মধ্যেই এলাকার দুই নারী এলেন খাবারভর্তি গামলা নিয়ে। সেই নারীরা জানালেন, ‘এখানে এলে মন ভালো হয়ে যায়। ঘরে ভালোমন্দ রান্না হলে আমরা মাঝে মধ্যে নিয়ে আসি।’
এখানে যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে নিহারি, গীতা রানী, এলাচি বেগম, হোসনা বেগম ও রোকেয়া বেগম নামের কয়েকজনের নাম জানা গেছে। নাম নাজানা অনেকের নতুন নাম দিয়েছেন রফিকুল ও কল্পনা। তাঁদের মধ্যে নিহারি বছর পাঁচেক আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিলেন। কথাবার্তা ছিল অস্পষ্ট। সেখান থেকে তাঁকে আনা হয় এই আশ্রমে। এখন তিনি পুরোপুরি সুস্থ। হিন্দি ও বাংলা মিশিয়ে কথা বলেন। তিনি জানালেন, তাঁর বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বুখোরায়। রফিকুল জানান, এখান থেকে এ পর্যন্ত চারজনকে নিয়ে গেছেন তাঁদের অভিভাবকরা। মারা গেছেন দুজন।

মহৎ উদ্যোগ
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের কোষাধ্যক্ষ ডা. মানস বণিক বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমের খবর জানতে পেরে সহকর্মী ডা. আশিকুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে একদিন রফিকের বাড়িতে গিয়েছিলাম। রফিক ও তাঁর স্ত্রীর কাজ দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। এরপর থেকে আমরা প্রতি মাসে আর্থিক সহায়তা ছাড়াও আশ্রিতদের সব ধরনের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, ‘এটা মহৎ কাজ। আমার তেমন কিছুই নেই। তারপরও এই বৃদ্ধাশ্রমে নিজের সাধ্যমতো অর্থ দেওয়ার চেষ্টা করি। মাঝে মধ্যে খাবার পাঠাই, খোঁজখবর নিই।’
চর বেতাগৈর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ফরিদ উদ্দিন বললেন, ‘আমরা যা পারলাম না তা করে দেখিয়েছেন রফিক। বৃদ্ধাশ্রমের মাসিক বিদ্যুৎ বিল আমি পরিশোধ করি। সম্প্রতি তাঁকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি কবরখানার জায়গা কেনার জন্য।’
নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনীল কৃষ্ণ পাল বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের একটি বৃদ্ধাশ্রম দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছি। এ ধরনের মহতী উদ্যোগে সবার সহায়তা করা প্রয়োজন। বৃদ্ধাশ্রমটি নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব।’
ময়মনসিংহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমটির বিষয়ে আমি ও আমার কার্যালয় অবগত। এরই মধ্যে নিবন্ধনের আবেদন পেয়েছি। সব ঠিকঠাক থাকলে দ্রুত নিবন্ধন পাবে।’
ময়মনসিংহ-৯ নান্দাইল আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহিন বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ কাজ। শুরু থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমে সহায়তা করছি।’

তবু আনন্দ আছে
এখন স্থানীয় সংসদ সদস্য, চেয়ারম্যান, ইউএনওসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গ্রামবাসীর সহযোগিতায় বৃদ্ধাশ্রমটি চালাচ্ছেন রফিকুল। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকরাও তাঁকে সহায়তা করেন। বাকিটার জন্য নির্ভর করতে হয়ে মানুষের অনুদানের ওপর। কখনো কখনো সংকটে পড়লে হাত পাততে হয়। তবু রফিকুল ও কল্পনার মুখে কোনো কষ্টের ছাপ নেই। আছে একসঙ্গে এক পরিবারে থাকার অনাবিল আনন্দ।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *