অভিজাত সমাজ রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করছে

অভিজাত সমাজ রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করছে

অর্থ ডেস্ক: সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে মূলত বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে। কারণ সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তান বৈষম্যমূলক আচরণ করত। আর এই বৈষম্য বেশি ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু বৈষম্য দূর করার সেই লক্ষ্য কতটা পূরণ হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখন অভিজাত সমাজ রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করছে। তারাই সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। মধ্যবিত্তের এখানে কোনো সুযোগ নেই। যেটা পাকিস্তানের শাসকদের সময়ও আমরা দেখিনি।’
বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক সেমিনারে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে রেহমান সোবহান এ কথা বলেন। বিআইডিএস সন্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনারে ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ : পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্তের বিকাশ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।
রেহমান সোবহান বলেন, ‘বর্তমান সমাজে মধ্যবিত্তরা তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। তারা সমাজে অগ্রণী ভূমিকাও রাখতে পারছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে পড়ছে দিনকে দিন।
দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রসার লাভ করা সত্তে ও তারা সেই সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছে না। বরং তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন সংসদের ৩০০ সদস্যের মধ্যে যদি জরিপ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে তাঁদের সন্তানদের অনেকে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা লাভ করছে। কেউ কেউ দেশের বাইরে পড়াশোনা করছে। ’
প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘১৯৭৫-এর পরবর্তী সময়ে এ দেশের মধ্যবিত্তরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল। তাদের মধ্যে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ছিল। শেখ মুজিবও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু পরে পরিস্থিতি অন্য রূপ নেয়। মধ্যবিত্তরা তাদের অধিকার হারাতে থাকে এবং একটা বিশেষ শ্রেণির হাতে সমাজের কর্তৃত্ব চলে যায়। তিনি আরো বলেন, ‘একাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে দেখা যেত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকত। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ। সেই বৈষম্য থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু এখন সমাজে অন্য ধরনের বৈষম্য দেখা যাচ্ছে, যা ক্রমবর্ধমান।’
মূল প্রবন্ধে আতিউর রহমান বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক ভূমিকা ছিল। ভাষা আন্দোলনের মূলভাগেই ছিলেন পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তরা। এ ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি আন্দোলনকারীর পিতা শহরে বাস করতেন। ৭০ শতাংশ আন্দোলনকারীর পিতা ৫ একরের বেশি জমির মালিক ছিলেন। ৬৮ শতাংশ আন্দোলনকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। নেতৃত্বে থাকা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির গ্রামের সঙ্গে, কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে ছিল গভীর সংযোগ। এই সংযোগ নিশ্চিত করতে যাঁরা মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল টানাপড়েনের মধ্যে। তাঁরা ছিলেন সামাজিক জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়লেও তারা সাংস্কৃতিক চেতনায় নিমজ্জিত নয়। এখনকার মধ্যবিত্ত অনেক বেশি অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক হলেও কম সাংস্কৃতিক। মধ্যবিত্তরা স্ববিরোধী। টানাপড়েনে কেউ নিচে নামে, আবার কেউ ওপরে ওঠে।’
সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে বিনায়ক সেন বলেন, ষাটের দশকে মাত্র ৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত ছিল। তারা আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এখন মধ্যবিত্ত প্রায় ৩০ শতাংশ। এর পরও তখনকার মতো ভূমিকা কেন রাখতে পারছে না, এটা একটা বড় প্রশ্ন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *