হাওরাঞ্চলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

হাওরাঞ্চলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

হাওরাঞ্চল দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চালের অন্যতম জোগানদাতা। যে বছর আগাম বন্যায় হাওরের ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই বছর দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। চালের দাম বেড়ে যায়। একইভাবে দেশের মিঠা পানির মাছের চাহিদারও একটি বড় অংশ আসে এই হাওরাঞ্চল থেকে।


কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া, মৎস্যসম্পদের অতিরিক্ত আহরণসহ নানা কারণে খাদ্য ও মাছের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত হাওরাঞ্চল ক্রমেই তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এতে হাওরে মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জোগান কমে যাচ্ছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রভাব ফসল উৎপাদনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।


বিশাল হাওরের বুকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য জনবসতি। বর্ষায় নৌকাই তাদের একমাত্র বাহন। এ বছর মধ্য জুনেও হাওরে ভাসান পানি হয়নি। নৌকা চলাচল করতে না পারায় হাওরের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। বোরো ধান উঠে যাওয়ার পর হাওরের বাসিন্দাদের, বিশেষ করে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন ভাসান পানিতে মাছ ধরা। এবার পানি না হওয়ায় উপার্জনের সেই পথও বন্ধ। অনেককে খেয়ে না-খেয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। অনেকের মতে, মাছ হাওরের অর্থনীতিতে ধানের চেয়েও বেশি ভ‚মিকা রাখে। হাওরাঞ্চলের হাটবাজারগুলো থেকে সারা দেশে মাছের জোগান যায়। কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।


এবার বর্ষা দেরিতে আসায় হাওরে মৎস্যকেন্দ্রিক অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া মাছের প্রজননও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক মাছ ভাসান পানিতে ডিম দেয়। বর্ষা দেরিতে শুরু হলে ডিম দেওয়া এবং মাছ বড় হওয়ার সময় কমে যায়। উৎপাদনে তার প্রভাব পড়ে। ধান-চালের ব্যবসায়ীরা জানান, পানি না থাকায় ধান-চালের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাধারণত বছরের এই সময়ে প্রতিদিন রাইস মিলে হাজার মণ ধান আসে। কয়েক শ বস্তা চাল বিক্রি হয়। হাওরে পানি না থাকায় ধান পরিবহন করা যাচ্ছে না। ফলে ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন। পরিবহনের সমস্যার কারণে অন্যান্য ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।


বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া ক্রমেই স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। কখনো কখনো অতিবর্ষায় অসময়ে বন্যা হচ্ছে, কখনো খরায় সব বিনষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান মতিন বলেন, এল নিনোর ফলে ভারতের আসামসহ এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হবে। এ রকম পরিস্থিতিকে ‘খুবই অস্বাভাবিক’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, স্বাভাবিক বর্ষা না হলে হাওরাঞ্চলে আগামী বছরের বোরো চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। খরাও দেখা দিতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অপরিকল্পিত ফসল রক্ষা বাঁধও হাওরে মাছসহ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে। মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উল্টো বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।


আমরা আশা করি, হাওরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে হাওরাঞ্চলের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *