সাম্য ও সম্প্রীতির নবি

সাম্য ও সম্প্রীতির নবি

মাহমুদ আহমদ: পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত এবং নবিকুল শিরোমণি হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর আগমন হয়েছিল রহমতরূপে। মহানবির সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে মানুষের মুক্তি সাধন, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, ঐক্য বিধান ও মানুষকে সুসভ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। তিনি বলেছেন ‘আমাকে সাদা-কালো নির্বিশেষে সবার জন্য পাঠানো হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমদ) তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মহানবি (সা.)-এর আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবি (সা.)-এর সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না লাশটি তাঁর সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হযরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহ্র রাউল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আল্লাহ্র রাউল উত্তর দিয়েছিলেন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১) কতই না অতুলনীয় ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা মসজিদে এক মরুচারী বা বেদুঈন আসে আর সেখানেই প্রস্রাব করতে বসে পড়ে। লোকজন তার দিকে ধেয়ে আসে বা ছুটে যায়। মহানবি (সা.) লোকদের বারণ করে বলেন, একে ছেড়ে দাও আর সে যেখানে প্রস্রাব করেছে সেখানে পানির বালতি ঢেলে দাও। তোমরা লোকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছ, কাঠিন্যের জন্য নয়।’ (বোখারি)
এরপর দেখুন, মহানবি (সা.)-এর ঘরে এক ইহুদির অতিথি হওয়া ও এরপর মহানবি (সা.)-এর অতিমানবীয় আপ্যায়নের ঘটনা খুবই বিখ্যাত। রাসুল (সা.)-এর সুমহান উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলামও গ্রহণ করে। হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর ঐতিহাসিক উদার চরিত্রকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে, ‘তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীদের তুমি ঘৃণা নাহি করে/আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।’ এরপর, মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশকটি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। তা সত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবি (সা.)-এর নামের সঙ্গে ‘রাসুলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম, আপনি আল্লাহর রাসুল, তাহলে তো আর আপনার সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসুল (সা.) সন্ধির লেখক হযরত আলী (রা.)-কে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লেখ। এতে আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করলে হযরত রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করেন কোথায় লেখা আছে, এরপর নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম: ৪/৬১, ইফাবা, ২য় সংস্করণ: ২০০৮ খ্রি.)।
ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবি (সা.) বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবি (সা.) বিজিত শক্রদের প্রতি কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার তো দূরের কথা কিঞ্চিৎ পরিমাণও প্রতিশোধস্পৃহা প্রকাশ করেননি, বরং শত্রুদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশরা! আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব বলে তোমরা মনে করো?’ তারা বলল, আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত।’ (আর-রাখিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৪৩৯)।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *