শিক্ষা বিস্তারে মর্জিয়া বেগমের সংগ্রাম – আসাদ উল্লাহ

শিক্ষা বিস্তারে মর্জিয়া বেগমের সংগ্রাম – আসাদ উল্লাহ

মর্জিয়া বেগম। এক মহীয়সী নারী। যেন একালের বেগম রোকেয়া। নারীর চেনা খোলস ভেঙে ক্রমে নিজেকে মানুষে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছেন। ছিলেন গফরগাঁও খায়রুল্লাহ সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক তো অনেকেই থাকেন। তবে কেন মর্জিয়া বেগম আলোচিত হবেন? কারণ তাকে পৃথক করা যায় আর দশজন থেকে।
পিতার চাকরি সূত্রে মর্জিয়া বেগমের জন্ম ১৯৪৭ সালের ৩১ অক্টোবর জামালপুর জেলায়। তবে পিতৃভূমি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার কাজিরগাঁও গ্রামে। তার কাল ছিল বাল্যবিয়ের কাল। তিনিও মেনে নিতে বাধ্য হন। তখন কেবল অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া এক কিশোরী তিনি। শাড়ি পরার কি বয়স হয়েছিল তার? তবু লাল শাড়িতে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। চলে আসেন ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার বড়গাঁও গ্রামের শ্বশুরালয়ে।
বাঙালি নারীরা বিয়ের পরপরই ঘর-বর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু বিয়ে তাকে ঘরবন্দি করতে পারেনি, শেকল পরাতে পারেনি পায়ে। চেষ্টা করা হয়েছিল অবশ্য। তার হিরণ্ময় প্রত্যয়ের কাছে পরাজিত হয় সব অপচেষ্টা। পড়ালেখা তিনি করবেনই। সব বাধা পেরিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে গেলেন। এসএসসি, এইচএসসির পর অনার্সসহ বাংলাভাষা ও সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ঘর-সংসার কি তবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন? না, সুসংহত ছিল তার ঘর। সবকিছু ঠিক রেখেই উচ্চশিক্ষা সুসম্পন্ন করেছেন। চার ছেলেমেয়ে সবাইকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
সোনারগাঁয়ের মেয়ে। ত্রিশালের পুত্রবধূ। থিতু হন গফরগাঁওয়ে। জীবনের সিংহভাগ খরচ করেছেন এ উপজেলায়। পড়ালেখা শেষ করেই শিক্ষকতায় যোগদান করেন। যখন তিনি গফরগাঁও খায়রুল্লাহ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছেন মাত্র। স্কুলটি বেসরকারি তখন। গফরগাঁও উপজেলা শহরে অবস্থিত স্কুলটি বালিকাদের একমাত্র আলোকিত স্কুল। শুধুই কি শিক্ষকতা করেছেন? না, অংশ নিয়েছেন সামাজিক, মানবিক কর্মকাণ্ডে। বিশেষ করে গফরগাঁওয়ের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তার উদার পৃষ্ঠপোষকতার কথা ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হবে সন্দেহ নেই। গঠন করেন ‘গফরগাঁও সাহিত্য পরিষদ’।
স্কুলে যোগদান করেই ছাত্রী-শিক্ষক-অভিভাবকদের মন কেড়ে নেন। দলমত নির্বিশেষে হয়ে যান সবার শ্রদ্ধার পাত্র। গফরগাঁও জনপদে মর্জিয়া বেগম নামটি ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বড় আপা সম্বোধন। মাতৃত্বের আঁচলে বন্দি করে রাখতেন ছাত্রীদের। তার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। প্রতিকূল স্রোতেই বেয়েছেন জীবনতরী। নারীর শিক্ষা, তাদের অগ্রগতির কথা ভেবেছেন প্রতিনিয়ত। এক সময় মেয়েদের কোনো পৃথক কলেজ ছিল না গফরগাঁওয়ে। আজকে গফরগাঁও উপজেলা শহরে যে মহিলা ডিগ্রি কলেজটি সগৌরবে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এর পেছনেও রয়েছে মর্জিয়া বেগমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। খায়রুল্লাহ স্কুলেই তার তত্ত্বাবধানে এর প্রথম কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯৮৪ সালে খায়রুল্লাহ স্কুলটি সরকারিকরণ হয়। এ সরকারিকরণের কাজটি বলা চলে তার একক প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হয়। গফরগাঁওয়ে এক জনসভায় যোগদান করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিশাল জনসভায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভাষণের শেষ দিকে দুটি প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের ঘোষণা দেন। এক. গফরগাঁও কলেজ। দুই. গফরগাঁও ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়। মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ঠিক এ সময় কয়েকজন ছাত্রী নিয়ে পথ আগলে দাঁড়ালেন প্রধান শিক্ষক মর্জিয়া বেগম। যেন বীরাঙ্গনা সখিনা, যেন অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা কিংবা ইলামিত্র। এরশাদ মঞ্চে ফিরবেন না বুঝতে পারলেন তিনি। খপ করে ওনার হাত ধরে ফেললেন। বললেন, ‘মেয়েদের একমাত্র আলোকিত প্রতিষ্ঠান খায়রুল্লাহ স্কুল। সরকারিকরণের ঘোষণা আপনাকে দিতেই হবে।’ মর্জিয়া বেগমের দৃঢ়তায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাধ্য হলেন পুনর্বার মঞ্চে গিয়ে খায়রুল্লাহ স্কুলটিকে সরকারিকরণের ঘোষণা দিতে।
তার কর্মদক্ষতা ক্রমে তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। পদোন্নতি পেয়ে হলেন স্কুল পরিদর্শক। সর্বশেষ আঞ্চলিক উপপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। দীর্ঘদিন এ পদে থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে অবসরে যান। অবসরে গিয়ে তিনি যেন আরও কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ময়মনসিংহ জেলা মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদে। অর্জন করেন জেলা জয়িতার সম্মাননা। বর্ণাঢ্য এ জীবন রেখে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর চিরবিদায় নেন মর্জিয়া বেগম। এ কর্মপ্রাণ নারী ময়মনসিংহ জনপদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার কাছে অনুকরণীয়, শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবেন যুগযুগান্তর।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *