শাফায়াত লাভের উত্তম পন্থা মিলাদ

শাফায়াত লাভের উত্তম পন্থা মিলাদ

ড. জাহাঙ্গীর আলম- মিলাদ আরবি শব্দ। এর অর্থ জন্মকাল। রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্মকালীন ঘটনাবলিকে মিলাদ বলা হয়। অর্থাৎ যে মহতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের প্রশংসামূলক আলোচনা করা হয়, তাকে মিলাদ বলে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহ্মাতাল্লিল আলামীন।” অর্থ- আমি আপনাকে জগতসমূহের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭)
মহান রাব্বুল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-কে জগতসমূহের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এই রহমত ও বরকত লাভের এক মোক্ষম পন্থা হলো মিলাদ। হযরত রাসুল (সা.)-এর কারণে মহান আল্লাহ্ সমগ্র বিশ্ব জাহান সৃষ্টি করেছন। তাঁকে সৃষ্টি না করা হলে কোনো কিছুই সৃষ্টি করা হতো না। স্রষ্টার সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ হলো মানুষ। যাকে আশরাফুল মাখলুকাত বলা হয়। সকল নবি-রাসুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো আমাদের দয়াল রাসুল (সা.)। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর এই সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুকে ভালোবেসে, সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি তাঁর জ্বিকিরকে সমুন্নত করেছেন। মহান আল্লাহ্ নিজে ফেরেশতাদের নিয়ে তাঁর প্রিয় বন্ধু হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর উপর দরুদ ও সালাম পেশ করেন। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “নিশ্চয় আল্লাহ্ স্বয়ং ও তাঁর ফেরেশতারা নবির উপরে দরুদ পাঠ করেন। হে মু’মিনগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরুদ পড় এবং শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬)
মহান রাব্বুল আলামিন সৃষ্টির শুরুতে আপন নুর হতে, নুরে মোহাম্মদীকে পৃথক করে তাঁর আশেক হয়ে ফেরেশতাদের নিয়ে দরুদ পড়েন। তাই বলা যায় সৃষ্টির শুরু হতে এই দরুদ ও মিলাদের অনুষ্ঠান চলমান, যা অদ্যাবধি নবির আশেক ও প্রেমিকরা পাঠ করে পরম শান্তি অনুভব করেন। এ প্রসঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (সা.) ফরমান- “সর্বপ্রথম আল্লাহ্ আমার নুর সৃষ্টি করেছেন। আমি আল্লাহ্র নুর হতে এবং সকল বস্তু আমার নুর হতে সৃষ্টি।” (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ৩)
মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও লালনকর্তা। আমরা তার হুকুমের গোলাম। তাঁর নির্দেশিত পথ ও মতে আমরা চলতে পারলেই তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হবো। তিনি আমাদেরকে যা হুকুম দিয়েছেন আমরা তা পালন করি। আল্লাহ্র হুকুম বান্দার জন্য ফরজ। মহান রাব্বুল আলামিন কোনো ইবাদত নিজে করেন না, তিনি শুধুমাত্র একটি কাজ করেন, তাহলো তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর উপর মিলাদ ও দরুদ পাঠ করেন। এই কাজ তিনি একা করেন না, ফেরেশতাদেরকে নিয়ে করেন এবং যারা মু’মিন তাদেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পেশ করার তাগিদ দিয়েছেন।
মোহাম্মদী ইসলামে মিলাদের গুরুত্ব অপরিসীম। মিলাদের মাধ্যমে হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বত হৃদয়ে জাগ্রত করা সম্ভব। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেম আপন হৃদয়ে হাসিল করে স্বপ্নে অথবা মোরাকাবার মাধ্যমে হযরত রাসুল (সা.)-কে দেখে হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ করে দোজখের আগুন হারাম করেছেন অগণিত আশেকে রাসুল। যারা দয়াল রাসুল (সা.)-কে দেখেছেন, তারা সত্যিই দেখেছেন। কারণ হযরত রাসুল (সা.)-এর চেহারা মোবারক শয়তান ধারণ করতে পারে না।
মিলাদের ফজিলত এত বেশি যে হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশাতেও সাহাবিগণের বাড়িতে মহাধুমধামের সাথে মিলাদের আয়োজন করা হতো। তাফসীরে জালালাইনের অন্যতম লেখক ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) প্রণীত ‘সাবিলুল হুদা ফি মাওলিদিল মুস্তফা’ কিতাবে আছে- বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেন যে, “তিনি একদিন হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে হযরত আবু আমের আনসারি (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলেন হযরত আবু আমের আনসারি (রা.) তার ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজনকে একত্রিত করে হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিনের বিবরণ শোনাচ্ছেন। অতঃপর তিনি বলেছিলেন আজ সেই পবিত্র জন্মদিন। তার এই কাজে হযরত মোহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত খুশি হলেন এবং বললেন, “হে আমের! নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য তাঁর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতারা তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, (যারা তোমার ন্যায় এমন কাজ করবে তারাও তোমার মতো ফজিলত পাবে)।”
অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়- একদা বিখ্যাত সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) তার ঘরে পাড়াপ্রতিবেশিদের একত্রিত করে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের বর্ণনা করছিলেন, যা শুনে উপস্থিত সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর উপর দরুদ ও সালাম পেশ করেছিলেন। এমন সময় হযরত রাসুল (সা.) সেখানে উপস্থিত হলেন এবং খুশি হয়ে তাদের উদ্দেশে বললেন, “তোমাদেরকে শাফায়াত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে।” (দুররুল মুনাজ্জাম) সুতরাং দয়াল রাসুল (সা.)-এর শাফায়েত লাভের জন্য আমরা তাঁর জন্মবৃত্তান্ত তথা মিলাদ পাঠ করতে পারি। এ প্রসঙ্গে মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন- “ঘরে ঘরে মিলাদ দিন, দয়াল রাসুলের শাফায়াত নিন।”
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বাড়িতে অনুষ্ঠিত মিলাদের ঘটনা স্বয়ং হযরত রাসুল (সা.)-এর উপস্থিতিতেই হয়েছিল। যে মিলাদ আয়োজন করার কারণে হযরত রাসুল (সা.) খুশি হয়ে ঐ উম্মতের শাফায়াত করা তাঁর জন্য ওয়াজিব বলে ঘোষণা করেছেন- এর চেয়ে উত্তম কাজ জগতে আর কি হতে পারে?
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে ভালোবাসার নাম ইমান। যে রাসুল (সা.)-কে যতটুকু ভালোবাসবে তার ইমান ততটুকু। হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসা মানে প্রকারান্তরে মহান রাব্বুল আলামিনকে ভালোবাসা। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হে রাসুল! আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। তবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩১) মহান রাব্বুল আলামিনকে ভালোবাসা এবং নিজেদের পাপসমূহ ক্ষমার জন্য দয়াল রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার বিকল্প নেই। দয়াল রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে ভালোবাসার অন্যতম মাধ্যম হলো, হযরত রাসুল (সা.)-এর উপর শ্রদ্ধার সাথে মিলাদ ও দরুদ পড়া। সকল নবি-রাসুল এবং আউলিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা পদ্ধতি একই। যে শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে একজন সাধারণ মানুষ মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়। জগদ্বিখ্যাত মহামানব মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজানের তিনটি প্রধান শিক্ষা যথা- আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা ও নামাজে হুজুরি। তার সাথে আরও একটি শিক্ষা সংযোজন করেছেন, তা হলো- আশেকে রাসুল হওয়া। আর এই আশেকে রাসুল হওয়ার জন্যই তিনি মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারীদের নিয়মিত মিলাদ ও দরুদ পড়ার তাগিদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দয়াল রাসুলের আশেক যারা সদা মিলাদ পড়ে তারা।” তিনি আরও বলেন, “আশেকে রাসুল ঘরে ঘরে, দয়াল রাসুলের মিলাদ পড়ে।” মিলাদ পড়ার তাগিদ দিয়ে তিনি দৈনন্দিন আমলে মিলাদকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং একজন আশেকে রাসুলকে ওয়াজিফা আমল করতে হলে তাকে দৈনিক সাতশ বারের অধিক দরুদ পাঠ করতে হবে। মিলাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, “হযরত রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসা লাভের আশায় এবং তাঁর সাক্ষাৎ কামনা করে কেউ যদি তাঁর উপর মিলাদ ও দরুদ পাঠ করে, তাহলে মহান আল্লাহ্ ওই বান্দার উপর সন্তুষ্টি হয়ে তাকে ৫টি পুরষ্কার দান করবেন। যথা- ১) মিলাদ পাঠকারীর সংসারের অভাব অনটন দূর হবে; ২) বালা-মুছিবত দূর হবে: ৩) সংসারের অশান্তি দূর হবে; ৪) আয়-রোজগারে বরকত হবে; এবং ৫) হযরত রাসুল (সা.)-এর শাফায়াত লাভ হবে। কারণ হযরত রাসুল (সা.) হলেন জগতসমূহের জন্য রহমত ও বরকত।
সূফী সম্রাটের সুযোগ্য উত্তরসূরি সিরাজাম মুনিরার ধারক ও বাহক, মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী মহামানব ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর ঘরে ঘরে মিলাদ পাঠ করার জন্য বিশেষ তাগিদ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, “আপনারা যদি ঘরে ঘরে মিলাদ দেন, তাহলে দলে দলে লোক আশেকে রাসুল হবে। রাসুলের আশেক সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। মানুষ হযরত রাসুল (সা.)-এর শাফায়াত লাভ করতে পারবে এবং দয়াল রাসুল (সা.)-এর দিদার লাভ করে ইহলোক ও পারলৌকিক শান্তি ও কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবে।” আল্লাহ্কে রাজি খুশি করার জন্য দয়াল রাসুল (সা.)-এর দিদার, সন্তুষ্টি অর্জন এবং শাফায়াত লাভের আশায় আমাদের সকলের মিলাদ পাঠ করা অত্যাবশ্যক। আসুন, আমরা সবাই এই রহমত ও বরকতময় কাজ করে ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সুখ, শান্তি ও কল্যাণ লাভ করি। মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলকে শ্রদ্ধার সাথে মিলাদ ও দরুদ পাঠ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *