মরছে পদ্মা মেঘনা

মরছে পদ্মা মেঘনা

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: অসংখ্য চর ও ডুবোচরে মরতে বসেছে দেশের প্রধান দুই নদী পদ্মা ও মেঘনা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক দ্বন্দের জেরে ড্রেজিং ও বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় প্রতিদিনই পলি জমে ভরাট হচ্ছে নদী দুটির বুক। জেগে উঠছে নতুন নতুন চর। এতে বিঘিœত হচ্ছে জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজনন। কমে গেছে পদ্মা-মেঘনার চাঁদপুর এলাকায় ইলিশের বিচরণ। অসংখ্য ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে নৌযান। এতে অনেক সময় নৌযানের তলা ফেটে ঘটছে দুর্ঘটনা। মূল নদীতে স্রোত কমে যাওয়ায় বিপন্ন নদী দুটির শাখা নদীগুলো। সেচ ঝুঁকিতে পড়েছে পদ্মা-মেঘনা অববাহিকায় থাকা দেশের বৃহৎ অঞ্চলের কৃষি। একই সঙ্গে বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় গত দেড় বছরে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে বালুর দাম। এতে থমকে গেছে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নকাজ। বাড়ছে নির্মাণব্যয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চাঁদপুরের সদর, মতলব উত্তর ও হাইমচর উপজেলার মেঘনায় জেগে উঠেছে শত শত ডুবোচর। চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনার মোহনায় বাঁশগাড়ী মৌজার কিনারা থেকে ১ কিলোমিটার নদীর ভিতরেও বৈঠা দিয়ে পাওয়া যাচ্ছে নদীর তলদেশ। অনেক ডুবোচর পূর্ণাঙ্গ চরে রূপ নিয়ে পেয়েছে নাম। জন্ম নিয়েছে চিরাচর, শিলার চর, ঘোড়ামারা চর, জাহাজমারা চর, ল²ীমারা চর, বঙ্গাশিয়া চর, চরমুকেশ, চরজগন্নাথ, চরনন্দনাল, চরপ্রকাশ, দক্ষিণ পৌয়ার চর, নিলার চরের মতো অসংখ্য চর। শুষ্ক মৌসুমে এসব চরে হচ্ছে আবাদ। অনেক চরে বাড়িঘরও উঠে গেছে। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মারও একই অবস্থা বলে সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, বালুমহালের ইজারা ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে চাঁদপুরে সরকারি দলের দুই নেতার দ্ব›েদ্বর জের উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরে আদালতের নির্দেশে মেঘনায় বালু উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বালু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভ‚মি মন্ত্রণালয় চাঁদপুর জেলা প্রশাসককে জরিপের মাধ্যমে বালুমহাল চিহ্নিত করে ইজারা দিতে অনুরোধ করলেও দীর্ঘদিনেও জেলা প্রশাসন থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, পদ্মা ও মেঘনার নতুন বালুমহাল ইজারা দিতে একটি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ভ‚মি মন্ত্রণালয় থেকে চাঁদপুর জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে চর ও ডুবোচরগুলো বালুমহালের উপযুক্ত হলে আইন অনুযায়ী ইজারা কার্যক্রম করতে অনুরোধ করা হয়। জবাবে একই বছরের ২ নভেম্বর চাঁদপুর জেলা প্রশাসক ভ‚মি মন্ত্রণালয়কে জানান, ‘চরগুলো বালুমহাল ঘোষণা করে বিধিমতে ইজারা প্রদানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জুলাই (২০২২) জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার সিদ্ধান্তের আলোকে মৌজাগুলো বালুমহাল ঘোষণার সম্ভাবতা যাচাই অব্যাহত রয়েছে।’ এরপর বছর ঘুরলেও এখনো শুরু হয়নি বালু উত্তোলন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, ‘বালু উত্তোলনের জন্য এখন পর্যন্ত চাঁদপুরে বালুমহাল ঘোষণা হয়নি। তবে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম চলছে। বালুমহাল ঘোষণা হলে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইজারা দিয়ে বালু উত্তোলন শুরু হবে। এ এলাকায় চর রয়েছে, কিন্তু চর নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। চরের কারণে নৌযান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে, এমন অভিযোগ কোনো নৌযান মালিক সমিতি করেনি। করলে আমরা সে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখব।’ ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়সূত্রে জানা গেছে, দুই দশকের বেশি সময় ধরে চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের বালু দিয়ে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন জেলা শহরের সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প ও নিচু ভ‚মি ভরাটের কাজ চলে আসছিল। বালুমহালগুলো ইজারা দিয়ে সরকার প্রতি বছর এক শ থেকে দেড় শ কোটি টাকা রাজস্ব পেত। এতে নদনদীগুলোর নাব্যও ঠিক থাকত। বালু উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় সিলেট, পাবনা, রাজশাহী অঞ্চল থেকে বালু এনে পূরণ করা হচ্ছে চাহিদা। দীর্ঘ পথ ঘুরে আনতে গিয়ে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে বালুর দাম। এতে রাজধানীসহ আশপাশ এলাকার সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, শিল্পকারখানা, বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে বহুগুণ। এদিকে বালু ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের মার্চে মেঘনায় বালু উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ে। ৩০০ ড্রেজার ও ১ হাজার ২০০ বাল্কহেডের ৩ লাখ কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ে। ড্রেজারে অন্তত ৩০০ কোটি ও বাল্কহেডে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল ব্যবসায়ীদের। গত বছরের মার্চে যে বালুর দাম ছিল প্রতি ঘনফুট ৪ টাকা, এখন তা ১০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। তারা বলছেন, কিছু ইজারাদার দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে নদনদীর তীরঘেঁষে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় স্থানীয়দের ফসলি জমি ও বাড়িঘর ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে জেলাগুলোর বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তে ২০১৬ সালের পর মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের সব বালুমহাল ইজারা বন্ধ করে দেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা। কিন্তু অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। মাঝখান দিয়ে বিপাকে পড়েন যারা বৈধভাবে বালু তুলছিলেন। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়সূত্রে জানা যায়, বিএনপির নেতৃত্বে জোট সরকারের সময় দেশের সব বালুমহাল ইজারা দেওয়া হতো খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) মাধ্যমে। ২০০১ সালের পর সংস্থাটি মুন্সীগঞ্জে ৩২, নারায়ণগঞ্জে ২৯ ও চাঁদপুর জেলায় ১৫টি মহাল থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্যরা ডিও লেটার দিয়ে যেসব ঠিকাদারের নামের তালিকা পাঠাতেন শুধু তারা নামমাত্র মূল্যে বালুমহাল ইজারা পেতেন। সেনাসমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার আমলে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে খোলা দরপত্রে বালুমহাল ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৭ সালে জেলা প্রশাসকরা দরপত্র আহŸান করেন। তাতে নারায়ণগঞ্জে ২৪, মুন্সীগঞ্জে ১০ ও চাঁদপুরে পাঁচটি বালুমহালের গড়ে দর পড়েছিল ৪০ লাখ টাকা করে। এদিকে ২০১৫ সালে চাঁদপুর সদর উপজেলার ল²ীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান মেঘনার চাঁদপুর সদর ও হাইমচরে অবস্থিত ২১টি মৌজা এলাকায় নিজ খরচে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল হাই কোর্ট ওইসব ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। তখন থেকে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত ওই এলাকায় বালু উত্তোলন করা হয়। চার বছর পর ২০২২ সালের মার্চে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। মে মাসে আদালত চাঁদপুরের মেঘনা থেকে সব ধরনের বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশের পর থেকে বন্ধ রয়েছে মেঘনাসহ বিভিন্ন নদনদীর বালু উত্তোলন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *