বিশ্ববরেণ্য লেখক ট্র্যাজেডির প্রতিষ্ঠাতা এইস্কিলাস

বিশ্ববরেণ্য লেখক ট্র্যাজেডির প্রতিষ্ঠাতা এইস্কিলাস

মাসুদুজ্জামান: খ্রিস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগের কথা। গ্রিসের সেই সময়টা ছিল বিশ্ব নাট্য-ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। তিন প্রথিতযশা নাট্যকার-এইস্কিলাস, ইউরিপিদিস ও সফোক্লিস তো ছিলেনই, ছিলেন আরো অসংখ্য নাট্যকার, যারা তাদের নাটক বিভিন্ন লোক-উৎসবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন। এইস্কিলাস ছিলেন তাদেরই একজন।

গ্রিক ট্র্যাজেডির প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয় তাকে। শুধু তা-ই নয়, সমগ্র পশ্চিমা সাহিত্যরীতির ধরন কেমন হবে, তিনি সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এইস্কিলাসের পরই আবির্ভাব ঘটে অন্য দুই বিখ্যাত নাট্যকার ইউরিপিদিস ও সফোক্লিসের। ‘বন্দি প্রমিথিউস’ ও ‘অরেস্টিয়া’ ট্রিওলজির মতো মৌলিক ট্র্যাজেডিগুলো কবিতার মহৎ ভাষায় অসাধারণ অনুভ‚তির চিন্তাশীল ও গভীর অনুধ্যানের সূত্রে প্রশংসিত হয়ে আসছে।

দুঃখজনক হলো, তিনি লিখেছিলেন ৯০টির মতো নাটক, কিন্তু রক্ষা পেয়েছে মাত্র সাতটি।
এইস্কিলাসের জন্ম ৫২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এথেন্সের উপকণ্ঠে এলুইসিসের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার বাবার নাম ইউফোরিয়ন। পরিবারটির ছিল এথেনীয় উত্তরাধিকার।
এলুইসিস গ্রিসের রহস্যময় একটি ধর্মকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এইস্কিলাসের জন্মের প্রায় ১০ বছর আগে এথেন্সের স্বৈরশাসক পেইসিট্রাটাস এই ধর্মকেন্দ্রটি এথেন্সের উপকণ্ঠে সরিয়ে আনেন। এখানেই তিনি সূচনা ঘটান একটি জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল বার্ষিক উৎসবের। এই উৎসবে নাচ-গান পরিবেশন করা হতো, থাকত কোরাস এবং এতে একজন কবি কবিতা আবৃত্তি করতেন। পরে এই উৎসবে ব্যঙ্গ নাটক ও পৌরাণিক প্রহসন যোগ করা হয়েছিল।

শর্ত ছিল, যা-ই পরিবেশন করা হোক না কেন, সেটি হতে হবে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিকে অবলম্বন করে লেখা নাটক। নাট্যকাররা পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। এইস্কিলাস প্রথম এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন ৪৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। কিন্তু তিনি ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগ পর্যন্ত কোনো পুরস্কার অর্জন করতে পারেননি। এরপর অবশ্য আর তাকে থেমে থাকতে হয়নি। বছরের পর বছর সাফল্য পেতে থাকেন।
এইস্কিলাস যখন তরুণ, তখন একবার পারস্য সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী গ্রিস দখল করার জন্য এথেন্সের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মাত্র ২০০ সেনা হারিয়ে গ্রিসের সুদক্ষ সেনারা পারস্য বাহিনীকে সমুদ্রের দিকে পিছিয়ে দেয়। যুদ্ধটি গ্রিকদের জন্য একটি গৌরবের বিষয় হয়ে উঠেছিল এবং এরই অনুপ্রেরণায় এইস্কিলাস ‘পারস্যবাসী’ নামে একটি নাটক রচনা করেন। এইস্কিলাসের নাটকগুলো হেলেনীয় দেবতা, জিউসের শাসন, অ্যাপোলো, আফ্রোদিতি ও এথেনাকে কেন্দ্র করে রচিত। গ্রিক ঐতিহ্যে ধর্মের রহস্য উদঘাটনের বিষয়টি নিষিদ্ধ ছিল। অ্যারিস্টটল লিখেছেন, এইস্কিলাস এই রহস্য উদঘাটনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ধর্মের রহস্য উন্মোচন করে ‘বন্দি প্রোমিথিউস’ নাটকটি লেখার কারণে দর্শকরা তার দিকে পাথর ছুড়ে মারে, কিন্তু শাস্তি ভোগ করতে হয়নি।

এইস্কিলাসের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। শুধু কয়েকজনের স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। তাদেরই একজন হচ্ছেন চিওসের আইয়ন, এইস্কিলাসের চেয়ে বয়সে ছোট একজন ট্র্যাজেডি রচয়িতা। তিনি লিখেছেন, একবার তারা দুজনে একসঙ্গে বক্সিং প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতায় একজন প্রচণ্ড মার খেতে থাকলে এইস্কিলাস বলেছিলেন, ‘দেখলে তো, অনুশীলন না করলে কী হয়। অনুশীলনের গুরুত্ব অনেক।’ আইয়নকে তিনি আরো বলেছিলেন, হোমারের মহান ভ‚রিভোজের তুলনায় তার নাটক হচ্ছে ‘সামান্য এক টুকরা মাছ মাত্র’। অর্থাৎ ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডেসিউস’-এর তুলনায় কিছুই নয়। সফোক্লিস বলেছিলেন, ‘যদিও তার নাটকগুলো প্রায় নিখুঁত, কিন্তু লেখার সময় তিনি কী লিখছেন নিজেই জানতেন না।’ এ কথা বলার কারণ হলো, মদ্যপান করতে করতে এইস্কিলাস লিখতেন। গ্রিসে এইস্কিলাসকে নিয়ে এ রকম অনেক গালগল্প প্রচলিত আছে।

গ্রিক থিয়েটার যখন গড়ে উঠছে, সেই সময়ের নাট্যকার ছিলেন এইস্কিলাস। পুরনো দিনের গ্রিক নাটক তেমন একটা পাওয়া যায় না। ফলে গ্রিক নাটকে এইস্কিলাস কতটা অবদান রাখতে পেরেছিলেন, সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করা কঠিন। এইস্কিলাসের মৃত্যুর এক শতাব্দী পরে অ্যারিস্টটল লিখেছিলেন, থিয়েটারের ইতিহাসে তিনি তার অবদান রেখে গেছেন। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সুরকার ও নাট্যকারদের ওপর তার অব্যাহত প্রভাব কেবল ট্র্যাজেডি নয়, অপেরার বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। এইস্কিলাসের কিছু নাটক যদিও আধুনিক কাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে, কিন্তু তিনি এথেন্সের প্রথম নাট্যকার ছিলেন না। উপযুক্ত নিদর্শন ও তথ্যের অভাবে এথেনীয় নাটকের উৎপত্তি এবং প্রাচীন রূপের সমাধান আর কোনো দিন সম্ভব হবে না। সেই নাটকগুলোর কাঠামো কেমন ছিল, সেটা অ্যারিস্টটল অনেকটাই বলে গেছেন। তিনিই এইস্কিলাসকে প্রথম দুটি চরিত্র এনে নাটক রচনার কৃতিত্ব দিয়েছেন। এর আগে নাটকে থাকত একটি চরিত্র আর কোরাস। কোরাসই অন্য চরিত্রের ভ‚মিকা পালন করত। এরপর ট্র্যাজেডি বা নাটকে তিনটি চরিত্রের উপস্থাপন ঘটান সফোক্লিস। ৪৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘ওরেস্টিয়া’ নাটকটি রচনার সময় এইস্কিলাস সফোক্লিসের রীতিটি গ্রহণ করেছিলেন। একটি নাটকে একটি চরিত্র আর একাধিক চরিত্রের উপস্থিতির মধ্যে যে পার্থক্য আছে, সেটি সহজেই বোঝা যায়। যখন নাট্যকার নাটকে একাধিক অভিনেতা যোগ করেন, তখন তিনি সহজেই চরিত্রদের মিথস্ক্রিয়া, উঁচু মাত্রার আয়রনি আর দ্ব›দ্ব-সংঘাত দেখাতে পারেন। দর্শক প্রতিটি চরিত্রের খারাপ ও ভালো দিকগুলো মূল্যায়ন করতে সমর্থ হয়। হ্যামলেটে এ রকমই একটি দৃশ্য আছে। সেই দৃশ্যে শোবার ঘরে হ্যামলেট তার মায়ের সঙ্গে কথা বলছে আর পলোনিয়াস তা শুনছে। তখনই হ্যামলেটের চাচা আর মায়ের চক্রান্ত বুঝে ফেলা যায় এবং হ্যামলেটের আচরণ দর্শকের কাছে সহজ হয়ে আসে। শেকসপিয়ার যে নাটকে এভাবে তৃতীয় চরিত্র এনেছিলেন, পূর্বদৃষ্টান্ত হিসেবে এইস্কিলাস ব্যবহার করেছিলেন বলেই শেকসপিয়ারের পক্ষে সেটি সম্ভব হয়েছিল। গঠনপর্বের নাট্যকার হয়েও এইস্কিলাস নাটকে আরো অনেক কিছু যুক্ত করেছিলেন; বিশেষ করে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক, নকশা করা জুতা, নৃত্য এবং সম্ভবত সুপরিসর মঞ্চ ব্যবহারের প্রথম কৃতিত্ব তারই।

এইস্কিলাস ৯০টি নাটক লিখেছিলেন। তার মৃত্যুর পর এগুলো অভিনীত হতো। তার উত্তরসূরি সফোক্লিস ও ইউরিপিদিসের হাতে ট্র্যাজেডি আরো সমৃদ্ধি লাভ করে। ট্র্যাজেডি বিশ্বনাট্য ঐতিহ্যে পরিণত হয়। নাট্যসমালোচনার রীতিও গড়ে ওঠে তার নাটককে কেন্দ্র করে। অ্যারিস্টটল রচনা করেন তার যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘কাব্যতত্ত¡’। প্রথম শতকে গ্রিক ট্র্যাজেডিকে অনুসরণ করেই রোমের নাট্যকার সেনেকা ট্র্যাজেডি রচনা করেন। সেনেকার নাটকের গভীর প্রভাব পড়েছিল রেনেসাঁস কালের ইউরোপীয় নাটকে। গ্রিক ট্র্যাজেডির গান ও অভিনয়ের অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি হয় অপেরা। বিশ্ব নাট্য-ইতিহাসে হোমারের ‘ইলিয়াড’-এর অনুপ্রেরণায় রচিত ট্রিওলজি ‘ওরেস্টিয়া’ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এটিই রক্ষা পাওয়া একমাত্র গ্রিক ট্রিওলজি। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন সর্বকালের একজন মহান নাট্যকার। ৪৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এইস্কিলাস মৃত্যুবরণ করেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *