বাস্তব কারণেই নতুন শিক্ষাক্রম

বাস্তব কারণেই নতুন শিক্ষাক্রম

সৌমিত্র শেখর
শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে সময়োপযোগী পাঠদান করা হয় এবং যুগের সঙ্গে তাল রেখে ছাত্রসমাজকে তৈরি করা হয়, যে ছাত্রসমাজ মূলত দেশের প্রধান জনশক্তি। দক্ষ ও যুগোপযোগী জনশক্তি না থাকলে দেশ এগিয়ে যাবে না। তাই শিক্ষাক্রম বা পাঠক্রম কোনোটাই ডগমা নয় যে হাজার বছর তা একই রাখতে হবে। কারণ যুগের চাহিদা পাল্টায় এবং তার ওপর ভিত্তি করেই পাল্টে যায় শিক্ষার ধরন।
প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আর সেই পরিবর্তনকে মাথায় রেখে আমাদেরও তৈরি হতে হবে। সে সূত্রেই সম্প্রতি দেশের শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই নতুন শিক্ষাক্রমের নিরিখে তৈরি করা পাঠক্রম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টাও দেখা যাচ্ছে বেশ করে! ছোট্ট কিন্তু একটি স্থূল প্রশ্ন দিয়েই আলোচনার গভীরে যাওয়া যেতে পারে এবং তা হলো, এই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সরকারই যদি সন্দেহপ্রবণ হতো, তাহলে জাতীয় নির্বাচনের এই বছর কি সেটি প্রয়োগের কথা ভাবত? তারা কি জানে না, বিরোধিতার রাজনীতি এ দেশে কেমন! নতুন কিছু হলে তার বিরোধিতা সহজেই করবে সরকারবিরোধীরা! মনে হয়, সরকার এই পাঠক্রম পরিবর্তনকে রাজনীতির ওপর স্থান দিয়েছে এবং তারা জানে যে সরকারবিরোধীরা হয়তো একে হাতিয়ার করবে, তারপরও সরকার এই নতুন শিক্ষাক্রম প্রয়োগের দিকে এগিয়ে গেছে। এখানে সরকারের একটি চ্যালেঞ্জ এবং সদিচ্ছার প্রমাণ কিন্তু আছে।
যে আপত্তিটি আসছে তা হলো, সৃজনশীল পদ্ধতিই ভালো, নতুন শিক্ষাক্রম গোল্লায় নিয়ে গেল! আপাত এটিই মুখ্য কথা। আসলেই কি গোল্লায় গেল? সৃজনশীল নিয়ে কী আলোচনা-সমালোচনা হয়নি? অবাক ব্যাপার, আজ সে পদ্ধতিই পুনর্বহালের জন্য চিৎকার শোনা যাচ্ছে! সৃজনশীল পদ্ধতিতে এমসিকিউ ও সিকিউ দুটি ভাগ আছে। এমসিকিউ বা নৈর্ব্যক্তিক কিন্তু পুরোটাই মুখস্থবিদ্যা।
আর সিকিউ বা লিখিত অংশে একটি উদ্দীপক থেকে চারটি প্রশ্ন করা হতো। প্রথমটি ছিল জ্ঞানমূলক। জ্ঞানমূলক বলতে ছাত্র-ছাত্রী জানে কি না, এটিই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারে কি না, সেটির কথা ছিল না। যেমন- প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রণসংগীতের রচয়িতা কে? ছাত্র উত্তর লিখল, ‘কাঝি নঝড়ুল ঈছলাম’।
এতেও ছাত্রটি এক নম্বরের মধ্যে এক পাবে। সে ঠিকঠাক লিখতে পারল না বটে, কিন্তু বোঝা গেল, সে তো জানে অর্থাৎ তার জ্ঞান আছে। এবার ভেবে দেখুন প্রিয় পাঠক, এই জ্ঞানের কোনো বাস্তব মূল্য আছে কি না! যে জ্ঞান ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না ছাত্ররা, সেই মুখস্থনির্ভর জ্ঞান যে কাজে আসে না, সেটি কে না জানে? অথচ এখন সৃজনশীলের পক্ষেই কিছু মানুষ দাঁড়াচ্ছে! সৃজনশীল পদ্ধতিতে দ্বিতীয় ধাপটি হলো, অনুধাবন। এতে থাকে ২ নম্বর। তারপর প্রয়োগ এবং সব শেষে উচ্চতর দক্ষতা। এখানে যথাক্রমে ৩ আর ৪ নম্বর। এভাবে ১০ নম্বরকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে শেষ দুই ধাপ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উদ্দীপক থেকে শিক্ষার্থী নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রশ্নের উত্তর লিখবে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো, উদ্দীপকগুলো শিক্ষকদের তৈরি করার কথা ছিল, যা শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার বাইরে বেশির ভাগ। তাই উদ্দীপক নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক উঠতে দেখা গেছে। শিক্ষকরা বানিয়ে উদ্দীপক দিতে গিয়ে কখনো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে যুক্ত করে ফেলেন বা আনেন রাজনৈতিক বিষয়। মজার এবং দুঃখের ব্যাপার হলো, উদ্দীপকগুলো শিক্ষকদের বানানোর কথা থাকলেও শেষে তাঁরা আর সেগুলো বানাতেন না। কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা শত শত উদ্দীপক বানিয়ে রাখতেন। সেগুলো থেকেই শিক্ষকরা বিভিন্ন পরীক্ষায় উদ্দীপক তুলে দিতেন। এই উদ্দীপক তৈরি করে গাইড বই লেখানোর জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে ছাত্র বা চাকরিপ্রার্থীকে ভাড়া করা হতো। তাঁরাও হাতখরচার জন্য এগুলো করতেন। আমাদের অভিভাবক এসব বই কিনে এনে ছাত্রদের মুখস্থ করাতেন। সৃজনশীল পদ্ধতিতে যাওয়া হয়েছিল যে কারণে, সেটি মূলত এ কারণেই কবরস্থ হয়।
অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল সৃজনশীল পদ্ধতির সূচনাকালীন ব্যক্তিদের একজন। আমি তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন পদ্ধতিটি কার্যকর হলো না? তিনিও বলেছিলেন, উদ্দীপককেন্দ্রিক পরীক্ষার নামে যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করা হয়েছে, মূলত সে কারণেই পদ্ধতিটি আর কার্যকর নয়। আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে বেশি পরীক্ষা মানেই বেশি জানা! অর্থাৎ বেশি বেশি পরীক্ষা দিলে ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি বেশি পড়বে এবং তারা ভবিষ্যতের জন্য বেশি বেশি করে তৈরি হবে। এখানে ‘বেশি বেশি’টাই মুখ্য বিষয়। কিন্তু তাঁরা কি জানেন, ‘যথাযথ’ হলো পরিমিতি আর ‘বেশি বেশি’ হলো লোভ! তাঁরা তাঁদের সন্তানদের পরিমিত জ্ঞান ও তা প্রয়োগের ক্ষমতার চেয়ে বেশি কিছু চাইছেন। এ কারণে সম্প্রতি অভিভাবকদের পক্ষ থেকে দাবি উত্থাপিত হয়েছে এবং সেটির প্রথমটি হলো, ছাত্রদের জন্য বছরে অন্তত দুটি লিখিত পরীক্ষা রাখতে হবে। বলা হয়েছে ‘অন্তত’। মানে, দুটির বেশি হলে ভালো। ছয়টি হলে কেমন হয়? অনেকে বলবেন, খুবই ভালো। কারণ সেটি ‘বেশি বেশি’। আর বেশি মানেই ভালো। কিন্তু মনে মনে যাঁরা বেশি খুশি হবেন, তাঁরা হলেন পরীক্ষা ব্যবসায়ী। সিটের ব্যবসা চলে তাঁদের। আমার এক নিকটাত্মীয় এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। মফস্বলে থাকে। তার কাছে শুনলাম, ১২ হাজার টাকা দিলে সব বিষয়ের সিট দেওয়া হবে। অন্য বন্ধুরা নিচ্ছে। তাই তাকেও টাকা দেওয়া হলো। সেগুলো আনানো হলো। কাগজের বিশাল স্তূপ। মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য যে কদিন বাকি আছে, প্রতিদিন গড়ে ২০ পৃষ্ঠা করে পড়লেও তা শেষ হবে না। এর মধ্যে আছে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ইংরেজি ইত্যাদি। যাঁরা পরীক্ষার জন্য হা-পিত্যেশ করছেন, তাঁরা কি তাঁদের সন্তানদের এই পরীক্ষার নামে ইঁদুরদৌড় সম্পর্কে জানেন? তাঁরা কি পরীক্ষা শেষে সন্তানদের বুকশেলফে রাখা বইগুলো নেড়ে দেখেছেন, সন্তানরা এর কতটুকু পড়েছিল? টেক্সট বুক বোর্ডের বই ছাড়া বাড়তি বহু বই-গাইড কিনতে হয় আমাদের সন্তানদের। এখন সে ব্যাপারটি আর থাকছে না।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কিছু অভিভাবকের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা দেখে মনে হচ্ছে, সন্তান শুধু তাঁদেরই। এই সন্তানরা তাঁদের বটে, কিন্তু এরা জাতির সম্পদ। এদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেশ গঠন কি সম্ভব? আমরা উন্নত বিশ্বে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছি, তার কারিগর তো এই সোনার সন্তানরাই। মনমানসিকতা আর কর্মস্পৃহায় এরা যদি উন্নত বিশ্বের মতো করে গড়ে না ওঠে, তাহলে কি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে? হবে না। সে কারণেই সন্তানদের শুধু ‘নিজের’ না ভেবে ‘দেশ ও জাতির’ ভাবতে হবে। এটি ভাবতে পারলেই অভিভাবকদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার লাঘব হবে। শুরুর কথাই আবার মনে করা যাক, শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে যুগোপযোগী করে দক্ষ মানবশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়, যে শক্তি মূলত দেশ গড়ে তোলে ও একে উন্নতির দিকে গতিশীল রাখে। এর বিপরীতটা নয়।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *