ঢাকার সবুজ এলাকা সবচেয়ে বেশি কমেছে গত ৮ বছরে

ঢাকার সবুজ এলাকা সবচেয়ে বেশি কমেছে গত ৮ বছরে

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা কমেছে গত ৮ বছরে। আর সবচেয়ে বেশি জলাভূমি ভরাট হয়েছে ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

রাজধানীর বাংলামোটরে বিআইপির সম্মেলন কক্ষে শনিবার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণা করেছে বিআইপি। বিআইপি ও নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান। ‘২৮ বছরে রাজধানীর জলাধার ভরাট এবং সবুজ নিধন: বাস্তবতা ও উত্তরণের পথনকশা’ শীর্ষক এই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ঢাকা শহরে (নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলো ছাড়া ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন) সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫৩ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালে তা কমে গিয়ে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে ঢাকায় জলাধার ও জলাভূমি ছিল ৩০ দশমিক ২৪ বর্গকিলোমিটার। পরের পাঁচ বছরে ওই জলাভূমির ১১ দশমিক ৮২ বর্গকিলোমিটার ভরাট করা হয়েছে। গবেষণায় ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই ২৮ বছরের মধ্যে জলাভূমি সবচেয়ে বেশি ভরাট হয়েছে ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে। এখন আছে মাত্র ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার। তবে গত আট বছরে জলাধার ভরাটের হার কমেছে। বিআইপির গবেষণা বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে শূন্য দশমিক ৪৪ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে।

বিআইপির এই গবেষণা এমন সময়ে প্রকাশ করা হলো, যখন আন্দোলন করেও রাজধানীর সাতমসজিদ সড়কে গাছ কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সড়কটির গাছ কাটছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় শত বছরে পুরোনো পুকুর ভরাটের পাঁয়তারা চলছে, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে হাতিরঝিলের একাংশ ভরাট করা হচ্ছে এবং আলু নিয়ে গবেষণা করতে রামচন্দ্রপুরে জলাধার ভরাট করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)।
বিআইপির অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, জলাধার ও সবুজ নিধন ও সংরক্ষণের বিষয়টি যতখানি টেকনিক্যাল, যতখানি সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ততখানিই রাজনৈতিক। তিনি বলেন, একটি দেশের উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বোঝায় না, বরং দেশের সব মানুষ যেন সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে পারে, সেই সভ্য দেশ গঠন করাই প্রকৃত উন্নয়ন।
অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সঠিক পরিকল্পনায় ব্যর্থতা আমাদের ভবিষ্যৎকে ব্যর্থতার দিকে ধাবিত করে। কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার সময় জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’ ঢাকার জলাধার ও পরিবেশ রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকাকে রক্ষা করতে না পারলে ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে না।
জলাশয় ও সবুজ এলাকার জন্য পৃথক বৈশ্বিক মানদন্ড আছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘এই মানদন্ডের কতটুকু ছাড় দিলে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য রাখতে পারবেন, সেটি ঠিক করতে হবে। ১২ শতাংশের জায়গায় ১০ শতাংশ রাখলে আমরা মানব। কিন্তু ২ শতাংশ রাখলে কীভাবে শহরকে বাসযোগ্য করবেন?’ তিনি বলেন, ‘এক মাস ধরে সাতমসজিদে সড়কে আমরা দাঁড়িয়ে আছি গাছ কাটার বিরুদ্ধে। গত রাতেও (শুক্রবার রাত) সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে ৩৭টি গাছ আছে, সেগুলো কেটে ফেলা হবে।’

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রস্তাবিত তুরাগ কমপ্যাক্ট টাউনশিপ প্রকল্প এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জলাধার ভরাট করে আবাসন গড়ার সমালোচনা করেন রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘রাজউক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি জলাশয় ভরাট করে, তাহলে আমরা কার কাছে বিচার চাইব।’ সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা কমেছে ৪৩ শতাংশ
শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে শহরের মোট ভূমির ১৫ শতাংশ সবুজ এলাকা রাখতে হয়। ঢাকা শহরে সেটি আছে মাত্র ৭ শতাংশ। ঢাকার সবুজ এলাকা কমার পেছনে পার্কগুলো কংক্রিটে আচ্ছাদিত করা, খেলার মাঠ দখল করে হাটবাজার ও ক্লাব স্থাপন করা এবং গাছ কাটাকে দায়ী করা হয়।
বিআইপির গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫২ বর্গকিলোমিটারে বেশি। পরের পাঁচ বছরে এটি বেড়ে ৬০ বর্গকিলোমিটার ছাড়িয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে ঢাকায় সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গার আয়তন কমতে থাকে। এখন এটি প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে (১৯৯৫ সালের তুলনায়) ৩০ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।
অনুষ্ঠানে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও সভাপতি অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুমান ও তাপমাত্রা বিদ্যমান সবুজ ভূমি ও জলাধারের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। ঢাকায় সবুজ ভূমি ও জলাধারের তুলনায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার তাপমাত্রা স্থানভেদে ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এ জন্য গাছ যদি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা নিধন না করে স্থানান্তর পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

জলাধার কমেছে ৮৬ শতাংশ
নগরের বাসযোগ্যতা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জলাভূমির ওপর গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা। বৈশ্বিক মানদন্ড অনুযায়ী, একটি শহর বাসযোগ্য রাখতে মোট ভূমির ১০-১২ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। ১৯৯৫ সালেও ঢাকা শহরের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি। এখন সেটি কমতে কমতে এখন ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে।
গবেষণামতে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় (নতুন ওয়ার্ডগুলো ছাড়া) মোট জলাভূমির প্রায় ৮৬ শতাংশ গত ২৮ বছরে ভরাট করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে জলাভূমি ভরাটের পেছনে সচেতনতার অভাব, আইনি কাঠামোর দুর্বলতা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে দায়ী করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন জলাধার রক্ষা করতে হলে মালিকদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত খাল আমরা আর তৈরি করতে পারব না। এগুলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’
কংক্রিটের আচ্ছাদন বেড়েছে
বিআইপির গবেষণা বলছে, গত ২৮ বছরে ঢাকা শহরে কংক্রিটের আচ্ছাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা (অবকাঠামো বা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে এমন এলাকা) ছিল ৬৪ বর্গকিলোমিটারের মতো। সেটি বেড়ে এখন প্রায় ১১৩ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। এর ফলেই জলাভূমি, সবুজ এলাকা, কৃষিজমি কমেছে বলে মনে করে বিআইপি।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *