আত্মশক্তির বিকাশ ভাবনায় মাওলানা রুমি

আত্মশক্তির বিকাশ ভাবনায় মাওলানা রুমি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: ‘আমি অনেক মানুষ দেখেছি যাদের শরীরে কোনো পোষাক নেই, আমি অনেক পোষাক দেখেছি যেগুলোর ভিতর কোনো মানুষ নেই’। সুফিকুল শিরোমনি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.)-এর তীক্ষè পর্যবেক্ষণে মানুষের মধ্যে আত্মবিকাশের শক্তি তথা মনুষ্যত্বের অনুসন্ধানের ফলাফল যেভাবে উৎকলিত হয়েছে তাতে তাঁর মানবতার দর্শন ফুটে উঠে। এই মানুষের মধ্যে সেই মানুষের খোঁজে যখন হয়রান হতে হয়, অন্তর্ভেদি বেদনার অবয়বে তখন বেজে উঠে রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের বাণী ও সুর। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের আত্মিক সাধনায় নিমগ্ন (খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে) না হলে যেমন নিজেকে চেনা যায় না- আকুতি জাগে না আত্মিক উন্নয়নের তেমনি মানুষের মধ্যে ‘মানুষ’ না থাকলে পোষাকি মানুষের স্বরূপ উন্মোচিত হয় না; স্বরূপের মাঝে অপরূপের সন্ধান মিলে না। টিএস এলিয়টের ‘রাইম অব দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার’ এর মধ্যেও আত্মসমালোচনা ও শাস্তিভোগের (কুলক্ষণ মনে করে নিরাপরাধ আলব্যাট্রস পাখিকে হত্যার পর অথৈ সাগরের লক্ষ কোটি বারি বিন্দুর মধ্যে পান করার মতো এক ফোঁটা পানি না পাওয়া) মধ্যে, নিরস্ত্র রাজা ডান কানকে ঘুমের মধ্যে তার নিরাপত্তা বিধায়ক স্বয়ং সেনাপ্রধান ম্যাকবেথ তার স্ত্রীর প্ররোচনায় হত্যার পর ম্যাকবেথ দম্পত্তি যেমন আজীবন আর ঘুমাতে পারেনি (গধপনবঃয যধং শরষষষবফ ঃযব ংষববঢ় ংড় যব রিষষ হড়ঃ ংষববঢ় ধহু সড়ৎব) এ মর্মযাতনার অনুভবের আয়নায় মনুষ্যত্বের জয়-পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। সহস্র জনেরে কাঁদিয়ে গঙ্গা কেন বইয়ে চলছে, লক্ষ কোটি ভারতবাসীকে সে কেন জাগিয়ে তোলে না এ প্রশ্ন তো আত্মবিকাশের আকিঞ্চন আকাঙ্খারই প্রতিধ্বনি। ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ সেই মানুষ তার সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে পিছাচ্ছে বা এগুচ্ছে তা তার কর্মযজ্ঞ যোজনার মধ্যে প্রকাশ পায়’। ‘মোমবাতি হওয়া সহজ কাজ নয়, আলো দেওয়ার জন্য প্রথমে নিজেকেই পুড়তে হয়’ রুমির এ পর্যবেক্ষণে মানুষের মধ্যে মানবতাবোধে জাগানোর জন্য আত্মবিশ্লেষণ ও বিচারের সাধনায় নিবেদিত হওয়ার শিক্ষা রয়েছে। ‘যদি তুমি চাঁদের প্রত্যাশা করো, তবে রাত থেকে লুকিয়ো না, যদি তুমি একটি গোলাপ আশা করো, তবে তার কাঁটা থেকে পালিয়ো না, যদি তুমি প্রেমের প্রত্যাশা করো, তবে আপন সত্তা থেকে হারিও না’। এ উপদেশ বাণীর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সাবধান সতর্কতার প্রলেপ। সব কিছু জেনে ফেলাই জ্ঞান নয়, জ্ঞান হলো কী কী এড়িয়ে যেতে হবে বা বর্জন করতে হবে তা জানা।

মাওলানা রুমি মনুষ্যত্ব বোধের উদ্বোধন প্রত্যাশা করে বলেছিলেন ‘সুন্দর ও উত্তম দিন তোমার কাছে আসবে না, বরং তোমরই এমন দিনের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত’। আত্মিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানুষকে মনুষ্যত্ব বিকাশের সাধনায় আনত হতে হবে। তার আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে রুমির সেই উক্তি ‘তোমার জন্ম হয়েছে পাখা নিয়ে, উড়ার ক্ষমতা তোমার আছে। তারপরও খোঁড়া হয়ে আছো কেন। তোমার হৃদয়ে যদি আলো থাকে, তাহলে ঘরে ফেরার পথ তুমি অবশ্যই খুঁজে পাবে। ‘কিংবা’ গতকাল আমি বুদ্ধিমান ছিলাম, তাই পৃথিবীকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি জ্ঞানী, তাই নিজেকে বদলে ফেলতে চাই।’ রুমি একাধারে বলে চলেছেন, ‘তুমি সাগরে এক বিন্দু পানি নও। তুমি এক বিন্দু পানিতে গোটা এক সাগর।’ নিজের দিকে নিজে তাকানোর আল্লামা ইকবালের, ‘আপকা দুনইয়া আপ পয়দা কর’ এর মধ্যেও খুজে পাই প্রেরণা, ‘অন্যের জীবনের গল্প শুনে সন্তুষ্ট হয়ো না, নিজের পথ তৈরি করো, নিজের জীবন সাজাও। আকাশ কেবল হৃদয় দিয়েই ছোঁয়া যায়। নতুন কিছু তৈরি করো, নতুন কিছু বলো, তাহলে পৃথিবীটা হবে নতুন। যে বাতাস গাছ উপড়ে ফেলে, সে বাতাসেই ঘাসেরা দোলে, বড় হওয়ায় দম্ভ কখনও করো না।’

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *