প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে

প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ব্যাপারটা নতুন নয়, প্রকৃতির ওপর মানুষের হস্তক্ষেপ অত্যন্ত পুরনো। প্রকৃতিকে জয় করতে হবে-এ প্রতিজ্ঞা নিয়েই মানুষের সভ্যতা এগিয়েছে। প্রকৃতিকে মানুষ ব্যবহার করছে, নিজের কাজে লাগিয়েছে এবং ধ্বংসও করেছে। ফলটা দাঁড়িয়েছে ভয়াবহ।
সভ্যতা যত এগিয়েছে, প্রকৃতির বিপদ ততই বেড়েছে, সারা বিশ্বে প্রকৃতি আজ যতটা ও যেমনভাবে বিপন্ন, তেমনটা আগে কখনো ঘটেনি; অথচ আজ এমন দাবি করা হয় যে সভ্যতা এর অগ্রগতির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু বিপদ তো শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষেরও। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা ব্যাপার আছে, প্রকৃতি সেই প্রতিশোধটা নিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মানুষ আজ যতটা বিপন্ন, তেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।
দারিদ্র্য তো ছিলই। তা দূর করার নানা রকমের চেষ্টা চলেছে, এখনো চলছে। খুব যে ফলপ্রসূ হয়েছে তা নয়, বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। তারা অপুষ্টিতে ভোগে, স্বাস্থ্যসেবা পায় না।
তাদের জীবনে অভাব রয়েছে বাসস্থান, বস্ত্র ও শিক্ষার। কিন্তু যে ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি তা এখন ঘটছে। বিশ্বজুড়ে সংকট দেখা দিয়েছে খাদ্যের। পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যাচ্ছে তা-ও গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
বিশ্ব আজ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক আলোকিত। সেই আলোর নিচে ভয়াবহ অন্ধকার ধরা পড়েছে। বার্ড ফ্লু নিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। ওই ব্যাধিতে অনেক মানুষ মারা যাবে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এখন খাদ্যাভাবে এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দুর্বল ও পঙ্গু হয়ে পড়েছে।
মানুষের এ বিপন্নদশার ব্যাপারটি যে হঠাৎ করে ঘটল তা নয়, লক্ষণ আগেই দেখা যাচ্ছিল; কিন্তু সভ্যতার উন্নতিতে গর্বিত মানুষ ভ্রূক্ষেপ করেনি। প্রকৃতির ওপর তার হস্তক্ষেপ ক্রমাগত বেড়েছে। প্রকৃতি এখন ভীষণ বিরূপ হয়েছে, প্রতিশোধ নিচ্ছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি-এসব বিপদ ভয়ংকর মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সব শেষে যা দেখা দিয়েছে তা হলো খাদ্যের ওই অভাব। এ প্রায় অবিশ্বাস্য সংবাদ। বিশ্ব এত এগিয়েছে, এত রকমের উদ্ভাবন ও আবিষ্কার ঘটেছে-চাঁদে গিয়ে বসবাসের কথা ভাবা হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দরুন বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নত বিশ্ব ব্যাপক হারে মানুষ খুনেও দ্বিধা করছে না। এমনকি সেই আদিম বর্বরতারকালে খাদ্য সংগ্রহ নিয়ে যে দুর্ভাবনা মানুষকে কাতর করে রাখত তা আবার দেখা দিয়েছে। কাকে বলব অগ্রগতির নিরিখ? বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতিকে, নাকি আদিম খাদ্যাভাবের প্রাদুর্ভাবকে?
খাদ্যাভাবের সঙ্গে প্রকৃতির ওপর মানুষের হস্তক্ষেপ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। লোকসংখ্যা বেড়েছে, ফসলের জমি বাড়েনি। কোথাও কোথাও উৎপাদনের জমি খালি পড়ে থাকে, অন্যত্র এর ভীষণ অভাব। ধরিত্রী উষ্ণ হয়েছে, অভাব দেখা দিয়েছে পানির। ফলে চাষের জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন যে জল সিঞ্চন তা বিঘ্নিত হচ্ছে। তপ্ত মাটি ফেটে যাচ্ছে, জমি উর্বরাশক্তি হারাচ্ছে। ঠিক এর বিপরীতে বরফ গলে যাওয়ার কারণে ওপর থেকে পানি নেমে আসছে নিচে। এতে সমুদ্রের পানি উঁচু হয়ে পড়ছে। এর ফলে প্লাবন দেখা দিচ্ছে। জ্বালানি পুড়িয়ে আবহাওয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণহানি ঘটছে মানুষের, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফসল ও ফসলের মাঠ। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্যসংকট।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য অনেক আগে থেকেই বলে এসেছেন, প্রকৃতিকে উত্ত্যক্ত করতে নেই, করলে প্রকৃতি বিরূপ হবে, হয়তো প্রতিশোধ নেবে। বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক প্রবক্তা ডারউইনও ওই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন; কিন্তু মানুষ সেসব কথা শোনেনি। একদিকে প্রকৃতির বন্দনাগান করা হয়েছে, তাকে নিয়ে শিল্প-সাহিত্য তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রকৃতিকে পরিণত করা হয়েছে পণ্যে। এর যা কিছু আছে সব কিছুই লুণ্ঠন করা হয়েছে। মানুষও আসলে প্রকৃতিরই অংশ; কিন্তু যতই সে উন্নত হয়েছে, ততই বিচ্ছিন্ন হয়েছে প্রকৃতি থেকে। ফলে একদিকে সে যেমন শিকার হয়েছে প্রকৃতির রুদ্ররোষের, অন্যদিকে নিজেও ভীষণ কৃত্রিম হয়ে পড়েছে। তার স্বভাবে দেখা দিয়েছে নিষ্ঠুরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা।
পানিকে বলা হয় জীবন। পানি ছাড়া জীবন নেই। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি, এক ভাগ স্থল-ভূগোলের বইয়ে এমনটিই পড়েছি; কিন্তু আজ পানীয় জলের ভীষণ অভাব দেখা দিয়েছে। পানি যে কেমনভাবে দূষিত হয়েছে, এর প্রমাণ আমাদের বুড়িগঙ্গা। তা এখন পরিণত হয়েছে একটি বিষাক্ত নর্দমায়; অথচ ওই বুড়িগঙ্গায়ও লঞ্চডুবি হয়, মানুষ মারা যায়। আগামী দিনে বিশ্বে নানা রকমের যুদ্ধ বাধবে বলে আশঙ্কা! এখন যুদ্ধ লাগছে জ্বালানি তেল নিয়ে, আগামী দিনে লাগবে পানি নিয়ে।
এই যে মানুষের হস্তক্ষেপ বলছি, তারা কোন মানুষ? সব মানুষ এ কাজ করে না। গরিবরা করে সামান্য পরিমাণে এবং যখন করে তখন ধনীদের কারণেই। তাদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে, তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ ঘটায়। মূল কাজটা ধনীদেরই। বলতে হবে পুঁজিবাদীদেরই। পুঁজিবাদী বিশ্বই মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি পোড়ায়। তারাই পানিতে বর্জ্য ফেলে, জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটায়, অনিবার্য করে তোলে বহু মানবিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। গরিবরা গরিব হয় ধনীদের কারণেই এবং গরিব অবস্থায় ধনীদের অনুকরণ করে।
চীন একসময়ে সমাজতন্ত্রী ছিল। আজ আর নেই। নেই যে তা বোঝা যাচ্ছে এর পুঁজিবাদী আচরণে। মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি সে-ও পোড়াচ্ছে। এ ব্যাপারে একদা যে দেশ তাদের ভয়ংকর রকমের শত্রু ছিল সেই আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে এবং রাজি হচ্ছে না জ্বালানি ব্যবহারের ব্যাপারে সংযত হতে। তাদের আচরণ অবিকল পুঁজিবাদের মহানায়ক আমেরিকার মতোই। চীন নিজের দেশের ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশকে এরই মধ্যে বিপন্ন করে তুলেছে। এখন ধরিত্রীকে তপ্ত করার ব্যাপারে হাত মিলিয়েছে আমেরিকার সঙ্গে।
পুঁজিবাদী বিশ্বই মানুষের জীবনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনে আবার তারাই বিপর্যস্ত মানুষের জন্য সাহায্য করবে বলে নানা রকমের আয়োজন চালায়। আমাদের দেশে প্রবাদ আছে-‘গরু মেরে জুতা দান’। এ ব্যাপারটিও ওই রকমেরই। ওই যে বলা হয়-‘তুমি সাপ হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝাড়ো।’ সাহায্যদানের ঘটনাটা সেই ধরনেরও বটে। দংশন তারা করেছে আবার প্রতিকারও তারাই করবে বলছে। এমন আচরণ তারা করবেই। এটি তাদের স্বভাব। কিছুতেই স্বীকার করবে না, বিপর্যয়ের জন্য তারাই দায়ী।
তারা যুদ্ধ লাগায়। মারণাস্ত্রের আঘাতে মানুষ মারে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলছে, লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করে দিয়েছে। অতীতের দুটি বড় বিশ্বযুদ্ধ তাদেরই কীর্তি। এখন প্রতিনিয়ত স্থানীয় যুদ্ধের উসকানি দিচ্ছে, বিবাদমান উভয় পক্ষের কাছে নগদ অর্থে অস্ত্র বিক্রি করছে। এ-ও তাদের হস্তক্ষেপের আরেক নৃশংস দৃষ্টান্ত বটে। উসকানি দিয়ে থামেনি, ইউক্রেনকে মাঝখানে রেখে পুঁজিবাদী দুই পক্ষ যুদ্ধ বাধিয়েছে।
পুঁজিবাদীরা অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র-সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে থাকে। নিজের দেশে করে, বিদেশেও করে। তারা সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। দরিদ্র সৃষ্টি করে আর গড়ে তোলে বৈষম্য। বৈষম্য দেখা দেয় ধনী ও দরিদ্রে, নারী ও পুরুষে, সবল ও দুর্বলে। যখনই কোনো বিপর্যয় ঘটে তখন এর আঘাতটা সবচেয়ে বেশি করে গিয়ে পড়ে দুর্বল মানুষজনের ওপর। সেবার সিডর আঘাত করল আমাদের দক্ষিণ অঞ্চলে। আশ্রয়হীন করল কতজনকে কে জানে! দেখা যাবে, তাদের বেশির ভাগই হচ্ছেন দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত। বিত্তবানরা সেখানে থাকেন না। যাঁরা থাকেন তাঁরা বিপদের আভাস পেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। মারা পড়ে নিরুপায় মানুষজন।
অত্যন্ত বিশেষভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয় মেয়েদের। তাদের পক্ষে আশ্রয়স্থল পাওয়া কঠিন, চলাফেরা কঠিনতর। তারা আটকা পড়ে থাকে আবার যখন ত্রাণসামগ্রী আসে তখন তারাই বঞ্চিত হয় বেশি করে। সাহায্য পুরুষদের হাতেই প্রথমে পৌঁছায়, অবশিষ্ট থাকলে তবেই মেয়েরা পায়। পরিবারের ভেতরে মেয়েদের যে অবস্থা, বাইরে এর ব্যতিক্রম হবে কী করে? হয় না, হবেও না। কেননা সমাজ পুরুষতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদও পুরুষতান্ত্রিকই। নারীকে অধীন করে রাখা ওই ব্যবস্থারই প্রতিফল। এখানে ওই ব্যবস্থার বাস্তবিক প্রকাশও বটে।
মোট কথা পুঁজিবাদের হস্তক্ষেপ আজ সর্বত্র। পুঁজিবাদের বিকল্প সামাজিক মালিকানা। বাঁচতে হলে সে পথেই যাওয়া চাই।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *