নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রহস্যময় জীবন

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রহস্যময় জীবন

রণক ইকরাম: ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে পটপরিবর্তনকারী অধ্যায় হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনামল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থাবা থেকে এ উপমহাদেশকে মুক্ত করতে ঝরাতে হয়েছে অনেক রক্ত, পাড়ি দিতে হয়েছে হাজারো বাধার জঞ্জাল। ব্রিটিশদের কবল থেকে ভারতবর্ষকে বাঁচানোর জন্য যেসব মহান বীর সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন কিংবদন্তি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। অহিংসা-উদারতা কিংবা ধৈর্যে নয়; বরং বল প্রয়োগেই ব্রিটিশদের তাড়াতে হবে- এই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন নেতাজি। স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।’ বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১১ বার কারারুদ্ধ করেছিল। নেতাজির হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, তাঁর মৃত্যু নিয়ে বছরের পর বছর কেবল রহস্যই বেড়েছে।
বাঙালি পরিবারের সুবোধ বালক
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালে ২৩ জানুয়ারি এক বাঙালি পরিবারে। সেই সময় তাঁর পরিবারের বসতি ছিল বর্তমান ভারতের ওড়িশার কটক শহরে। তবে সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোদালিয়া নামক গ্রামে। নেতাজির পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন আইনজীবী। কর্মক্ষেত্র ছিল কটক। তাঁর মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। তিনি ছিলেন পিতামাতার চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। তাঁর ছাত্রজীবন শুরু হয় কটকের র‌্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। কলকাতার স্কটিস চার্চ কলেজ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছেলেবেলায় নেহাতই সুবোধ বালকের মতো দেখতে মনে হলেও সুভাষের বিপ্লবী মনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল ছাত্রজীবন থেকেই। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন তিনি।
ইংল্যান্ডে অবস্থানকালেই ঝড়
এরপর তিনি ইংল্যান্ডে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিটজ উইলিয়াম কলেজে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এ কলেজের পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং মরাল সায়েন্স ক্যামব্রিজ ট্রাইপস অধিকার করেন।
সুভাষচন্দ্র যখন ইংল্যান্ডে তখন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ঘটে যায় নানা ঘটনা। এর মধ্যেই ১৯১৯ সালে মহাত্মা গান্ধী ‘রাউটাল বিল’ বাতিলের আবেদন জানান। একই বছর এপ্রিলে সর্বভারতীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় এবং হরতাল পালিত হয়। পাঞ্জাবে গান্ধীর প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে তিনি সেই নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পাঞ্জাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তখন দিল্লি যাওয়ার পথে গান্ধীকে গ্রেফতার করা হয়। সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গান্ধীজির এই আন্দোলন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকান্ডের ঘটনার পর সুভাষচন্দ্র তীব্র ব্রিটিশবিরোধী হয়ে ওঠেন। ফলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রত্যাখ্যান করে তিনি ভারতে ফিরে আসতে চাইলেন। তাঁর উদ্দেশ্য তখন একটাই- যে করেই হোক ব্রিটিশদের ভারত থেকে উৎখাত করতে হবে।
গান্ধী-চিত্তরঞ্জনের ছত্রছায়ায়
১৯২১ সালের ১৬ জুলাই ভারতে ফিরেই গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন নেতাজি। গান্ধীজির নির্দেশে দেখা করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে। চিত্তরঞ্জন দাস সেই সময় সবার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন। কলকাতায় ফিরে প্রথমে সংবাদপত্রে লেখালেখি এবং পরে বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্ব পান। এরপর দেশবন্ধু কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হলে তাঁর অধীনে বেশ কিছুুদিন কর্মরত ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দি করা হয়। বন্দি অবস্থাতেই যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
সামরিক কংগ্রেস!
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা কংগ্রেসকে সামরিক কায়দায় সাজান। এক্ষেত্রে তিনি যে বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলেন, তার নাম ছিল ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’। সেই সময়ে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্ল¬বী ছিল। ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীকে সামরিক শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। ‘হিন্দুস্থান সেবক দল’ নামে আরেকটি বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছাড়াও গঠিত হয় সশস্ত্র বিপ্ল¬বী দল যেমন- অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, পূর্ণদাস বাউলের দল, উত্তরবঙ্গের বিপ্লবী সংগঠন। যা সে সময় সবার নজর কাড়ে। ১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে ‘নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক দিবস’ উপলক্ষ্যে একটি শোভাযাত্রার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ২৩ সেপ্টেম্বর সুভাষ জেল থেকে ছাড়া পান। এ বছরই তিনি কলকাতা করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩১ সালে আবারও কারারুদ্ধ হন এবং মুক্তিও পান।
গ্রেফতার তেজগাঁওয়ে
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ অক্টোবর ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ডুর্নোকে হত্যা করেন তৎকালীন বাংলার দুই বিপ্ল¬বী সরোজ গুহ এবং রমেন ভৌমিক। এদের পুলিশ ধরতে না পেরে ঢাকার স্থানীয় লোকদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। এর প্রতিবাদে তিনি ঢাকায় রওনা হলে ১১ নভেম্বর তেজগাঁও রেলস্টেশন থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ নভেম্বর ৫০০ টাকা জামিনে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
ক্রমে ক্রমে বিপ্ল¬বের কেন্দ্রে
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারিতে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ইংরেজদের সব ধরনের রাজনৈতিক অত্যাচার বন্ধ করার দাবি করা হয় এবং সাত দিনের মধ্যে এই দাবি না মানলে আইন অমান্য আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়। এই সূত্রে সরকার গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেলসহ বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। বোম্বে থেকে ফেরার পথে বোম্বে রেলস্টেশনের ৩০ মাইল দূরে কল্যাণপুরে সুভাষ বসুকে গ্রেফতার করা হয়। বন্দি অবস্থায় তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৩৩ খিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ভিয়েনার উদ্দেশে বোম্বে থেকে জাহাজযোগে রওনা দেন। ৮ মার্চ তিনি ভিয়েনায় পৌঁছান। একটু সুস্থ হয়ে তিনি ইউরোপের সুইজারল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ আরও দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ফিরলে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনি আবার ইউরোপ যান এবং ফেরতও আসেন। আস্তে আস্তে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যেমন প্রবল বিক্রমে এগোতে থাকেন, তেমনি ডালপালা মেলতে শুরু করে সুভাষ বসুর বিপ্লবী চেতনাও। ১৯৩২ সালে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সচিব এমিলিকে বিয়ে করেন। ১৯৪২ সালে তাঁদের কন্যাসন্তান অনিতার জন্ম হয়।
বহিষ্কৃত সেই ছেলেটি…
নেতাজির জীবনের শুরুর দিকের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটা সম্ভবত তাঁর ছাত্র জীবনেই। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত তিনি কটকের একটি ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টুর্য়ার্ট স্কুল। এরপর তিনি ভর্তি হন কটকের র‌্যাভেনশ কলেজিয়েটে। এই স্কুল থেকেই ১৯১১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। মেধাবী সুভাষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক ওটেন ছিলেন ভারতবিদ্বেষী। তিনি প্রায়ই ভারতবিদ্বেষী কথা বলতেন।
তরুণ সুভাষের মনে দেশপ্রেম জেগে ওঠে। তিনি কিছুতেই এসব কথা মেনে নিতে পারলেন না। অধ্যাপক ওটেনের ভারতবিরোধী কথাবার্তার ঘোর বিরোধিতা করেন নেতাজি। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজ অধ্যাপকের দাপট ছিল বেশি। ফলে অধ্যাপক ওটেনের সমর্থকদের দ্বারা প্রহৃত হন সুভাষ। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্রসহ সুভাষ বসুকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর তিনি স্যার আশুতোষ চৌধুরীর সহায়তায় স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোরে যোগ দেন এবং সমরবিদ্যার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে তিনি দর্শনে বিএ (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর অভিভাবকরা তাঁকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলেত পাঠান।
চলবে

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *