ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে শান্তি

ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে শান্তি

ড. মোবারক হোসেন
মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীতে যখনই মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়, মানুষ ধর্মকে ভুলে অধর্মের দিকে ধাবিত হয়, মানুষের মাঝে যখনই ভালো ছেড়ে মন্দের প্রতি উৎসাহ বৃদ্ধি পায়, একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যাবতীয় পাপাচার, অনাচার, ব্যভিচার, হত্যা, রাহাজানিসহ যাবতীয় পাপের কাজ বৃদ্ধি পায় সাথে সাথেই জগতে নেমে আসে অশান্তি। চারিদিক হয়ে উঠে মানবতা শূন্য। স্বাভাবিক জীবন হয় ব্যাহত, বিরাজ করে অশান্তি এবং জনজীবন হয়ে উঠে অতিষ্ঠ। ঠিক তখনই এই অশান্তি বিদূরিত করতে আবশ্যিক হয় উঠে শান্তির অবগাহন। শান্তির স্রোতে সমস্ত অশান্তিকে ভাসিয়ে দিয়ে জগতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয় মানবতাবাদী শান্তির ধর্ম। এই শান্তির অবগাহনকারী ব্যক্তিটিই হয়ে থাকেন যুগের মহাপুরুষ বা শান্তির দূত।
তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিকায়নের যুগে অনেক মানুষ রয়েছেন যারা হলেন বিজ্ঞানমনস্ক। তাদের নিকট বিজ্ঞান মতে শান্তির উন্মেষ ঘটিয়ে প্রকৃত ধর্মের রস আস্বাদন করিয়ে শান্তির দিকে ধাবিত করার মানসে যুগোপযুগী মহামানবের আবির্ভাব হয়ে থাকে। তিনি শান্তির চরিত্রের শিক্ষা দিয়ে অশোভিত মানুষকে সুশোভিত করে তোলেন।
ঈশ্বর ও উপাসনা পদ্ধতির মতবাদই ধর্ম। কর্তব্য ও অকর্তব্য সম্বন্ধে জ্ঞানই মানুষের ধর্ম। ধর্ম অর্থ সদাচর, সুনীতি ও আচরণবিধি। জীব বা বস্তুর নিজস্ব গুণ হলো পদার্থের ধর্ম। প্রবৃত্তি হলো পশুর ধর্ম। মূলত ধর্ম শব্দটি ধৃ+ম (মন) ধাতু থেকে আগত। ধৃ অর্থ হলো ধারণ করা। অর্থাৎ- আমাদের মন বা অন্তর যা ধারণ করে তাই আমাদের ধর্ম। এখানে ধারণ করা বিষয়টি হতে পারে কোনো ব্যক্তি বা তাঁর আদর্শ অথবা কোনো নিয়মনীতি। যেমন- কেউ সনাতনী আদর্শে যেমন মূর্তিকে বন্দনা করা, ধুপ-আগরবাতি দিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রের যপ ইত্যাদি বিশ্বাস করে এখানে এটাই তার ধর্ম অর্থাৎ তিনি সনাতনধর্মাবলম্বী। কেউ হযরত ঈসা (আ.) ও তাঁর নির্দেশিত নিয়ম-নীতিকে অন্তরে ধারণ করেছেন, এখানে তার ধর্ম হলো খ্রিষ্ট ধর্ম। আবার কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, সেটাও একধরনের বিশ্বাস। যদিও আমরা তাকে নাস্তিকবাদী বলে থাকি। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ধর্ম হলো কতগুলো নিয়ম-নীতির শৃঙ্খল যা একজন ব্যক্তিকে মন্দ কাজ (নিজের ও অন্যের অনিষ্ট) থেকে দূরে রাখে এবং পুণ্যকর্ম ও সৎকর্মের দিকে ধাবিত করে।
বিজ্ঞান শব্দটির ব্যুৎপত্তি বি+√জ্ঞা+অন থেকে। শব্দ দুটি বিশেষ অর্থে প্রয়োগ হয়েছে। বিজ্ঞান শব্দের অর্থ হলো বিশেষ ধরনের জ্ঞান। মূলত পরীক্ষা, প্রমাণ ও যুক্তি দ্বারা নির্ণীত সত্যকে বিজ্ঞান বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সুসংবদ্ধ জ্ঞানকেই বিজ্ঞান বলা হয়। বৈজ্ঞানিক শব্দের অর্থ হলো বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় বা বিজ্ঞানসম্মত। আবার অন্যভাবে বলা যায়, বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষভাবে জ্ঞাত। শান্তি অর্থ হলো- প্রশান্তি, উৎকণ্ঠা শূন্যতা, চিত্তের স্থিরতা, ভিন্ন মত পোষণকারী দুটি দেশের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস, বিষয়টি হতে ইন্দ্রিয়ের নিবৃত্তি, লালসা দমন বা নিবৃত্তি বা উপশম, উৎপাত শূন্যতা, অবসান, সমাপ্তি, সন্ধি যুদ্ধাবসান, কল্যাণ ও বিশ্রাম।
অবগাহন অর্থ হলো জলে শরীর ডুবিয়ে স্নান বা ডুব দিয়ে গোসল, শান্তির পরশে নিজেকে সিক্ত করা। সাধারণভাবে শান্তির অবগাহন বলতে প্রশান্তি দ্বারা নিজের দেহ ও মনকে পরিশীলিত করাকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, শান্তির প্রবাহ দ্বারা অশান্তি দূরীভূত করা।
জ্ঞান ও বিজ্ঞানের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। জ্ঞানের প্রায় সকল শাখাতেই বিজ্ঞানের যুক্তি লক্ষ্য করা যায়। তবে জ্ঞানের যেমন অনেক শাখা রয়েছে, যেমন- চিকিৎসাশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্র, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি। তদ্রুপ বিজ্ঞানের অনেকগুলো শাখা রয়েছে। সকল বিষয়কে যেমন জ্ঞানের সকল স্তর থেকে সঠিক পরিমাপ করা যায় না, তেমনি বিজ্ঞানের সকল শাখা দিয়েও ধর্মকে পুরোপুরি পরিমাপ করা যায় না। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের যে শাখাটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত সেটি হলো মনোবিজ্ঞান ও মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের নীতি ব্যবহার করে ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করার যে পাঠ তাকেই ধর্মের উৎপত্তি বিষয়ক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান বলা হয়। ধর্মের মনস্তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি ধাপ। বিজ্ঞানের এই শাখার মতো মানুষের যাবতীয় শান্তির একমাত্র উৎস হলো মন। মনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যে আনন্দ উৎপন্ন হয় তাকেই আমরা শান্তি বলে থাকি। এর সাথে দেহ ও মন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মন দ্বারা দেহ পরিচালিত হয়, আবার দেহ দ্বারা মনের কর্মের পরিণতি প্রকাশ পায়। আমাদের জীবনে যত কর্ম উৎপন্ন হয় সেই সমস্ত কর্মের উৎপত্তিস্থল হলো মন বা চিত্ত। যাবতীয় ভালো কিংবা মন্দ, সুখ অথবা দুঃখ, শান্তি কিংবা অশান্তিসকল কিছু উৎপন্ন হয় মনে। সেটা হোক প্রাণীর কিংবা মানবের। অনেকাংশ যার প্রতিফলন ঘটে তার দেহের মাধ্যমে। আমরা যখন কোনো ভালো কর্ম করি তার পূর্বে আমরা সেই ভালো কর্মের চিন্তা করে থাকি। হতে পারে সেটি কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক ন্যানো সেকেন্ড পূর্বের চিন্তা। কিন্তু এটি সত্য যে কর্ম করার পূর্বে আমার মনে কর্মের চিন্তা উদয় হয়। সেটি ভালো কর্মই হোক বা মন্দ কর্মই হোক। যেমন- ব্যবসা শুরু করার পূর্বে অবশ্যই চিন্তা করে থাকেন তিনি কী ব্যবসা করবেন, কীভাবে করবেন ইত্যাদি। অর্থাৎ ব্যবহারের পূর্বে ব্যবসার চিন্তা বা কর্মপদ্ধতি আগে আমাদের মনে উদয় হয়। তারপর কার্যে পর্যবসিত হয়ে থাকে। তদ্রুপ শান্তি কিংবা অশান্তির চিন্তাও প্রথমে আমাদের মনে উৎপন্ন হয়ে থাকে। শান্তির জন্য আমাদের মনে শান্তির চিন্তা উৎপন্ন করতে হয়, যাকে বলা হয় চেতনা। অর্থাৎ চিন্তা উৎপন্ন করতে হয়। চিন্তা উৎপন্ন অবস্থাকে বা চিন্তা গুণসম্পন্ন মন বা চিত্তকে চৈতন্য বলা হয়। সর্বোপরি বলা যায় মন বা চিত্তই শান্তির মূল উৎস। শান্তি নির্ভর করে যার যার মনের অবস্থার উপর। যে বৃত্তের সাহায্যে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী তার চারপাশে জগত ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং কোনো বিষয়ে চিন্তা বা কোনো কিছু অনুভব করতে পারে তাকে মন বলে। মন শব্দের একাধিক সমার্থক শব্দ পাওয়া যায়। মন শব্দের সমার্থক শব্দ হলো চিত্ত, চিন্তন, মনন, বিজানন, হৃদয়, অন্তঃকরণ, অতিন্দ্রিয় ইত্যাদি।
‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ, শান্তি। স্রষ্টার প্রতি বিনীতভাবে অনুগত হয়ে, অর্থাৎ আল্লাহ্তে আত্মসমর্পণ করে সৃষ্টির সাথে একাত্মতা স্থাপন করার নামই ইসলাম। মহান আল্লাহ্ বলেন-“মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে বিকিয়ে দেয়। আর আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের অত্যন্ত মেহেরবান।” (সূরা বাকারা ২; আয়াত ২০৭) মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্য পারিবারিক সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, কিংবা আইনগত ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজন হয় না, কারণ অন্যান্য প্রাণী স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে পরিচালিত। মানুষ যখন নফস তথা জীবাত্মার তাড়নায় পরিচালিত না হয়ে, আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিচালিত করবে, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই শান্তি লাভ করবে। যে কারণে অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের নির্দেশ করেছেন- “হে মু’মিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ২০৮)
সৃষ্টির আদি থেকে মহিমান্বিত আল্লাহ্ একে একে নবি ও রাসুলদের প্রেরণ করে আসছেন, যেন এসকল মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইসলামের মর্মবাণী, অর্থাৎ শান্তির বিধান প্রচার করেন এবং মানুষের অন্তরে শান্তি পৌঁছে দিয়ে ইসলাম যে বাস্তবিকই শান্তির তা উপলব্ধি করতে পারে। মহান আল্লাহ্ পরবর্তী বেলায়েতের যুগে যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আউলিয়ায়ে কেরামকে প্রেরণ করেন। তাদের মতে ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম, মুক্তিকামী মানুষকে এটি উপলদ্ধি করার সুযোগ করে দেন। অন্ধকার রাতে যে ব্যক্তির কাছে জ্বালানো বাতি রয়েছে, তার কাছে গেলে যেমন আলো পাওয়া যায়, তেমনি পথভ্রষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং ষড়রিপুর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে অশান্তির জাতাকলে পিষ্ট মানুষ যখন শান্তির দূত মহামানবের সহবত লাভ করে, তখন সে শান্তির সন্ধান পেয়ে যায়। আল্লাহ্ বলেন “হে রাসুল (সা.)! বলুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্রই। আর শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ঐ বান্দাদের উপর, যাদেরকে তিনি মনোনীত করেছেন।” (সূরা আন নামল ২৭: আয়াত ৫৯)
মানুষ যখন আল্লাহ্র মনোনীত মহামানবের দেওয়া বিধান অনুসরণ করে ষড়রিপুর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়, অতঃপর অন্যায় কর্ম থেকে বিরত থাকে এবং সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্র পরিচয় লাভ করে। তাঁর উপর পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজেকে সর্বোত্তম পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়, তখন নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে মূলত এটিই ইসলাম। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়ছে, তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন “হে আল্লাহ্র বান্দাগণ! তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থেকো। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তাকে নির্যাতন করতে পারে না, হেয় মনে করতে পারে না এবং অপমান-অপদস্থও করতে পারে না। অতঃপর আল্লাহ্র রাসুল (সা.) নিজের ক্বালবের দিকে ইশারা করে, এ বাণীটি তিনি তিনবার বলেন। তাক্ওয়া এখানে। আর কোনো ব্যক্তির খারাপ প্রমাণিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, সে তার মুসলমান ভাইকে, হেয় মনে করে। প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, ধনসম্পদ এবং মানসম্মান (বিনষ্ট করা) অপর সব মুসলমানের উপর হারাম।” (মুসলিম শরীফের সূত্রে রিয়াদুস সালেহীন ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৩, হাদিস নং ২৩৫) যে মত ও পথ অনুসরণ করলে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে সক্ষম হয়,তাকেই প্রকৃত ইসলাম বলা হয়।
সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য মানসিক শান্তির বিকল্প নেই। এজন্য সুস্থ সমাজেও নিরাপত্তা অনুভূতি অপরিহার্য। শান্তির মাধ্যমে মানুষের উন্নত গুণগুলোর বিকাশ এবং পরিপূর্ণতা লাভ করে। বর্তমান যুগে মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও মানসিক সংকট এবং আধ্যাত্মিক শূন্যতা ব্যাপক মাত্রায় বিরাজ করছে। মানবজাতি আজ ব্যক্তিজীবন, সমাজ জীবনে সর্বক্ষেত্রে শান্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কাক্সিক্ষত শান্তি ও সুখ অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিজ্ঞানের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাহ্যিক কিছু আরাম-আয়েশের অনেক উপকরণ তৈরি করা সত্ত্বেও মানুষ তার আত্মিক ও মানসিক শান্তির কোনো উপকরণ পাচ্ছে না। মহান রাব্বুল আলামিনের বাণী মানুষকে আধ্যাত্মিক ও মানসিক শান্তি দিতে পারে। সঠিক, সুন্দর পরিপূর্ণভাবে ইসলাম পালন করলে মানুষের আত্মার আত্মিক ও মানসিক শান্তি লাভ করা সম্ভব। মহান প্রভুর প্রতি সঠিক বিশ্বাস মানুষকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে পারে। এ বিশ্বাস একা একা সাধনা করে লাভ করা যায় না, কোনো সঠিক পথ প্রদর্শকের সাহায্য নিয়ে সাধনা করে লাভ করতে হয়। এই বিশ্বাস অর্জন করতে হয়। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত তার বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে সৎপথে চলে এবং অসৎ পথ পরিত্যাগ করে ও কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে তখন তার মধ্যে শান্তি বিরাজ করে। মানুষের মনে শান্তি নির্ভর করে তার ইমানের গভীরতার উপর। মানুষ যত বেশি প্রভুর অনুগত হয় তত বেশি তার ইমানের গভীরতা জোরদার হয়ে শান্তি লাভ করতে থাকে। আলেক্স কার্লের মতে- “মানুষ প্রার্থনার মাধ্যমে নিজের সীমিত শক্তিকে মহান আল্লাহ্র শক্তির সাথে যুক্ত করে।” পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “জেনে রেখ, আল্লাহ্র স্মরণেই অন্তর পরিতৃপ্ত হয়ে থাকে।” (সূরা রা‘দ ১৩: আয়াত ২৮) বিশিষ্ট আলেম ও তাফসীরকারক আল্লামা তাবাতাবায়ীর মতে- মানসিক প্রশান্তিই মনের একটি উচ্চতর পর্যায়ের নিদর্শন। এ ধরনের মানুষ হন দৃঢ়চেতা ও প্রজ্ঞার অধিকারী। প্রশান্তি কেবল পবিত্র অন্তরে ও খোদাভীরু ব্যক্তির হৃদয়েই নেমে আসে। এই প্রশান্তি ক্রমেই তার ইমানকে দৃঢ় করে এবং বৃদ্ধি করে খোদাভীতি বা তাকওয়া।
মানবের মাঝে রুহ বা পরমাত্মা বিদ্যমান থাকায় মানবাত্মা ও ফেরেশতার আত্মার উত্তম বৈশিষ্ট্য ও গুণ মানুষের মাঝে কাজ করে থাকে। বিষয়টি হাদিস শরীফে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) সুস্পষ্ট করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- “আল্লাহ্র রাসুল এরশাদ করেন- “শয়তান বনি আদমের মনে একরূপ ধারণা জন্মায় এবং ফেরেশতা একরূপ ধারণা জন্মায়। অর্থাৎ শয়তান মন্দ কাজের ও সত্যকে অস্বীকারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং ফেরেশতারা মঙ্গল ও সত্যকে গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে। যাহার মনে এই উৎসাহ উদগত হইবে, সে যেন ভাবে যে, ইহা আল্লাহ্র পক্ষ হতে হয়েছে। অতঃপর যেন সে আল্লাহ্র প্রশংসায় ব্যাপৃত হয়। আর যার মনে মন্দভাব উদগত হয়, সে যেন তৎক্ষণাৎ আল্লাহ্র নিকট এর প্ররোচনা হতে পানাহ চেয়ে নেয়। এটা বলে তিনি এই আয়াতটি পড়েন: ‘শয়তান তোমাদেরকে অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ হতে ক্ষমতা ও অনুগ্রহের ওয়াদা করেন’।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৫ এবং তাফসীরে ইবনে কাছীর ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৬৮)
রুহ বা পরমাত্মার মানবাত্মা ও ফেরেশতার আত্মা একইস্থানে অবস্থান করে। এটি প্রতিটি মানুষের মাঝে বিবেক বা আকলরূপে কাজ করে। মানুষ যখন পাপের দিকে ধাবিত হয়, তখন বিবেকের অনুশাসন অমান্য করে ধাবিত হয়। অর্থাৎ পাপ কাজ করার সময় কুরিপুর তাড়না এমন প্রবল হয় যে, সে তার অন্তরস্থ পরমাত্মার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে। এমনিভাবে পাপ কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে কুরিপুর বল শক্তিশালী হতে থাকে। এভাবে কুরিপুর শক্তির তুলনায় মানুষের বিবেক দুর্বলতর হয়ে গেলে, বিবেককে শক্তিশালী করে কুরিপু দমন করার জন্য প্রেরিত মহামানব তথা নবি, রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরামের রুহানি সাহায্য অবশ্য প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্র রাসূল (সা.) এরশাদ করেন- “ঐ জাতের কসম! যাঁর হস্ত মোবারকে আমার প্রাণ। আমার সহবতে থাকাকালে কিংবা আমার নসিহতকালে তোমাদের মনের যে অবস্থা হয়, সেই অবস্থায় যদি তোমারা সর্বক্ষণ থাকতে, তাহলে তোমাদের শয়নকক্ষে ও পথে-ঘাটে ফেরেশতারা তোমাদের মুসাফা করত।” (মুসলিম শরীফের সূত্র তাফসীরে মাজহারী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৯)
মহান রাব্বুল আলামিনের এ বাণী মোবারকে বিষয়টি সুস্পষ্ট, মানুষ সামাজিক জীব। তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হবে, অন্যের কল্যাণ সাধন ও উপকার করবে। এমনিভাবে তারা একটি শান্তির সমাজ বিনির্মাণ করবে। উপরন্ত মানুষ মাত্রই শান্তির প্রত্যাশী। অথচ আজকের দিনে মানুষ অশান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ। শান্তির অন্বেষায় মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু তারা অশান্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। এর মূল কারণ মহান প্রভু থেকে বিমুখ হওয়া ও আল্লাহ্র দেওয়া বিধান থেকে বিচ্যুত হওয়া। মহান আল্লাহ্ বলেন- “হে রাসুল (সা.)! আপনি বলে দিন: আমিতো আত্মসমর্পণ করেছি আল্লাহ্র কাছে এবং আমাকে যারা অনুসরণ করে তারাও। আর যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের এবং নিরক্ষরদের বলুন: তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে, তবে অবশ্যই তারাও সরল-সঠিক পথ পাবে। কিন্তু যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনার দায়িত্ব তো শুধু পৌঁছে দেওয়া। আর আল্লাহ্ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ২০) মহান আল্লাহ্ অন্য আয়াতে এরশাদ করেন- “আর যখন সে ফিরে যায়, তখন সে চেষ্টা করে যাতে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্র ও জীব-জন্তুর বংশ বিনাশ করতে পারে। আল্লাহ্ অশান্তি পছন্দ করেন না।” (সূরা আল বাকারা ২: আয়াত ২০৫)
মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ জ্ঞানী মনে করার কারণে আল্লাহ্র উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের সীমিত বিচার বুদ্ধির উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়ার ফলে মানুষ ব্যক্তিগত জীবনের চরিত্রহীনতা এবং সামাজিক জীবনে পাপাচার বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষ নিজেদের কৃতকর্মের ফল এই আল্লাহ্ প্রদত্ত স্বর্গীয় শান্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। হযরত রাসুল (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরাম সর্বাবস্থায় আত্মসমর্পিত থেকে, তাঁর রাসুলের নির্দেশিত পথে পরিচালিত হওয়ায় তার ব্যক্তিজীবনে, পরিবার জীবনে ও সমাজ জীবনে শান্তি উদ্যোগী হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে সামেত (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- “আমরা আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর কাছে মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করার, সুখ-দুঃখে, বালা-মুসিবতে, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক সর্বাবস্থায় [রাসুল (সা.)-এর] আনুগত্য করার এবং নিজেদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য প্রদানের বাইয়াত গ্রহণ করেছি।” (বুখারী ও মুসলিম শরীফের সূত্রে রিয়াদুস সালেহীন ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩০, হাদিস নং ১৮৬)
শান্তিকেই মানসিক শান্তি বলে। একজন মানুষ যখন তার সকল আকাঙক্ষা পূরণের সুযোগ পায় তখন সে অবশ্যই মানসিকভাবে শান্তি অনুভব করে। আর সুযোগ মানুষ তখনই পায়, যখন সে তার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণের মাধ্যমে তাঁর অনুগ্রহ লাভ করে। প্রকৃত ও মানসিক শান্তি অবগাহন করতে হলে আল্লাহ্র প্রেরিত মহামানবদের সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁদের উপর পরিপূর্ণ বিশ^াস রেখে জীবন পরিচালনা করতে পারলে, মানসিক ও আত্মিক শান্তি লাভ করা সম্ভব হয়। মানুষ নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদকে পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র মনোনীত মহামানবগণের কাছে আত্মসমর্পণ করে মহান প্রভুর নির্দেশিত পথে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয় তখন মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং হৃদয়ে শান্তি অনুভব করতে সক্ষম হয়।
মূলত বৈজ্ঞানিক সামাজিক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শান্তি অনুভব করতে হলে মহান রাব্বুল আলামিন কর্তৃক প্রেরিত শান্তির দূত মহামানবদের অনুসরণ করে জীবনের প্রতি মূহূর্ত অতিবাহিত করতে পারলেই সমাজ জীবনে রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি লাভ করা সম্ভব।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *