সৌমিত্র শেখর
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এভাবেই কবি বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন নিশ্চয়। কিন্তু এটিই নজরুল আর বাংলাদেশের একমাত্র সম্পর্ক নয়। বাংলাদেশের মাটি নজরুলকে আজকের নজরুল হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই প্রণোদনা দিয়েছে আর বাংলাদেশের মানুষতো নজরুলকে দিয়েছে তাঁর মনেরও শান্তি। দারা-পুত্র-পরিবারের যে পরিধি কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্টি করেছেন, সেখানেও আছে বাংলাদেশ।
শুধু তা-ই নয়, প্রেমের সাগরেও বাংলাদেশ দিয়েছে নজরুল চিত্তে বহু অবিস্মরণীয় দোলা। আর বাঙালির সংকটে-আবর্তে নজরুল হন উদার সহায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নজরুল ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের একেবারে সঙ্গে সঙ্গে! তাঁর লেখা ‘লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’-এর মতো অনেক লেখাই জাগ্রত রেখেছে মুক্তিকামী বাঙালিদের। তাই বাংলাদেশে নজরুল শুধু কবিমাত্র নন। সব আলোচনা হয়তো ছোট পরিসরে এখানে করা সম্ভব নয়, কিন্তু ইঙ্গিত কিছু রেখে যাওয়া হয়তো যায়।
১৪ বছর বয়সে যখন নজরুল দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত, তখন তিনি বর্ধমানের অন্ডালের রেলস্টেশনের কোনো এক বাঙালি বাবুর রান্নাঘর সামলেছেন, পরে আসানসোলে কোনো এক রুটির দোকানেও রুটি বানানোর কাজে হাত দিয়েছেন। সবটাই পেটের তাগিদে। কিন্তু মনের তাগিদ সেখানে তাঁর ছিল না মোটে। তাই সুযোগ পাওয়া মাত্র তিনি, বলা চলে পালিয়ে এসেছেন! আসলে উদাস নয়নে তিনি কখনো কখনো রুটির দোকান থেকে বাইরে এসে দাঁড়াতেন, স্টেশনের গানওয়ালা ভিক্ষাজীবীদের গান শুনতেন মন দিয়ে। কিন্তু তাঁদের মতো হয়ে যাবেন, সেই স্বাধীনতা তাঁর ছিল না। ময়মনসিংহের ত্রিশাল তখন ছোট্ট একটা জনপদ। দারোগা রফিজউল্লাহ, যিনি নিজেও বংশে কাজী-কর্মসূত্রে ছিলেন আসানসোলে। রুটির দোকানের ছোট নজরুল তাঁকে আকৃষ্ট করেছিলেন নিশ্চয়ই। তাই ঠিক ১৫ বছরের বালক নজরুলকে তিনি নিয়ে আসেন আসানসোল থেকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে। ভর্তি করে দেন স্কুলে। স্কুলটির নাম দরিরামপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। এখন অবশ্য নামটি পাল্টে করা হয়েছে নজরুল একাডেমি। এই পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল না। পর্যটকরা এখন ত্রিশালে এসে দরিরামপুর বিদ্যালয় আর খুঁজে পান না। সবাই তো আর জানেন না, দরিরামপুর বিদ্যালয় আজকের নজরুল একাডেমি! নাম পরিবর্তনের এই সংস্কৃতি ইতিহাসকে কখনো কখনো পিছু টেনে ধরে, এ ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। সে যাই হোক, সে সময় কাজী রফিজউল্লাহর বাড়ি কাজীর সিমলা থেকে দরিরামপুর বিদ্যালয়ে যাওয়া নজরুলের পক্ষে অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছিল। নিচু মাটি আর বিলের জনপদ ছিল সেদিনের ত্রিশাল।
অসুবিধাটা বুঝে নজরুলকে জায়গির রাখা হয়েছিল স্কুল থেকে হাঁটা দূরত্বের বেচুতিয়া বেপারির বাড়িতে। সেখান থেকেই নজরুল স্কুলে যেতেন। স্কুলে তিনি যতটা মনোযোগী ছিলেন, এর চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহী ছিলেন গান গাওয়ার ক্ষেত্রে, বাঁশি বাজানোর বেলায়, বটতলায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। এর একটা কারণ ছিল। এই কারণটিই নজরুল-মানসকে একেবারে বদলে দেয়। কারণটি হলো ত্রিশালের মাটি আর আবহাওয়া। ত্রিশাল বললে বৃহৎ অর্থে এখানে বাংলাদেশকেই বোঝাবে। কারণ ত্রিশালে আসাই মূলত বাংলাদেশে নজরুলের প্রথম আগমন।
ত্রিশালের মাটি আর আবহাওয়া নজরুলের মনে পরিবর্তন সাধন করেছিল কেন? কারণ নজরুল তাঁর শৈশবে যে বাংলার রূপ ও প্রকৃতি দেখেছিলেন, বাংলাদেশের রূপ ও প্রকৃতি ছিল তার রীতিমতো বিপরীত। আসানসোল-বর্ধমান মূলত রাঢ় অঞ্চলের অধিভুক্ত। এখানকার পরিবেশ রুক্ষ আর কঠিন। বর্ষা ও শীতের দিনগুলো বাদ দিলে এখানে সারা বছর বয়ে চলে গরম বাতাস এবং শরীরে সব সময় তপ্ততা অনুভূত হয়। গ্রীষ্মের প্রখর তাপে বনবাদাড়, আকাশ-বাতাস তখন যেন জ্বলতে থাকে। স্থানীয় মানুষকে তখন মূলত প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এখানকার ভূমি বেশ অসমতল ও পাথরযুক্ত বলে সহজে কৃষিকাজও হয় না। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘রাজমহল দক্ষিণ হতে আরম্ভ করে এই পুরো ভূমি প্রায় সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজমহল, সাঁওতাল, মানভূম, সিংভূম, ধলভূমের মালভূমি এই ভূমির অন্তর্গত। তারই পূর্ব দিক মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশের উচ্চতর গৈরিক ভূমি। এই ভূমি মালভূমির অংশ এবং একান্তইপার্বত্য, বর্ণময়, অনুর্বর। ’এ রকম একটি পরিবেশে কাজী নজরুল ইসলাম অন্তত জীবনের প্রথম ১৪ বছর পর্যন্ত বড় হয়েছেন। এর পরই তিনি যখন চলে আসেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে, তখন নানা কারণেই এই দুই অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুর পার্থক্য তাঁর অনুভবে স্পষ্ট হয় এবং মনের দিক থেকে তিনি পাল্টেও যান। ভূমিগত বৈশিষ্ট্যের বিচারে এই অঞ্চলে মোটামুটি প্রাচীন পলি ও দোআঁশ মাটি দেখা যায়। সেই সঙ্গে সবুজের সমারোহ এবং বৃক্ষ ও তৃণগুল্মের ব্যাপক সমাহারও থাকে সারা বছর। বৃষ্টি আর জল যেন এই অঞ্চলের নিয়মিত প্রবাহ। বিলে এখানে জমে থাকে স্বচ্ছ জল আর নিয়মিত বারিপাতে মাটি থাকে কর্দমাক্ত। নজরুল খুব বেশিদিন ত্রিশালে ছিলেন না। বলা চলে ১৯১৪ সালের পুরোটা। মানে এক বছর। এরপর তিনি আর এ দিকটায় আসেননি।
১৯১৭ সালে নজরুল সেনাদলে যোগ দিয়ে লাহোরে গিয়েছিলেন। সেখানে দুই বছরের একটু বেশি সময় অবস্থান করেন। নজরুলের সাহিত্যে করাচিতে এই দুই বছর অবস্থানের অভিজ্ঞতা ব্যাপকভাবে কার্যকর। কিন্তু এর চেয়েও বড়কথা, নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবনের মূল বাঁক ফিরেছিল তাঁর ত্রিশালে আগমনের পরিপ্রেক্ষিতে। নজরুল যে তাঁরসাহিত্যে স্নিগ্ধ বাংলার রূপায়ণ করতে পেরেছেন সারা জীবন ধরে: কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অভিভাষণ-সব মাধ্যমে এই রূপায়ণটি দেখা গেছে, এর সূচনাটাই করে দিয়েছিল নজরুলের ত্রিশাল আগমন। এরপর অবশ্য তিনি পূর্ব বাংলার কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ফরিদপুর, জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অনেকবার এসেছেন এবং বাংলার রূপ-প্রকৃতি গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন, তার সূচনাটি কিন্তু হয়েছিল ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকেই। অনেক লেখায়ই নজরুল বাংলার ভূ-প্রকৃতি বা এর রূপৈশ্বর্য তুলে ধরেছেন কিন্তু তা পশ্চিমবঙ্গের নয়, বাংলাদেশের। এটি তিনি জোর করে করেননি, হয়েছে সাবলীলভাবে। যেমন-একটি গানে নজরুল বলেছেন, এই দেশের বুকে নিরবধি শত নদী বয়ে চলে; সাগরের স্রোত চরণের নূপুরের মতো বাজতে থাকে; গ্রীষ্মকালে নাচে বামা কালবৈশেখী ঝড়ে; আবার হঠাৎ বর্ষাতে মাটিধস নামে, বন্যাও হয়; শরৎকালে শেফালিকা ফুল ফোটে আর দুর্গা দেবীর আগমন ঘটে; হেমন্তে হরিত আঁচল যেন দেখা যায় প্রকৃতির গায়ে; শীতের অলস বেলায় গাছ থেকে পাতা ঝরে; ফাল্গুনে প্রকৃতিতে দেখা দেয় ফুলের বাহার। এই বর্ণনাটি বাংলাদেশের সঙ্গেই হুবহু মেলে, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে শতভাগ মেলে না। এখানেই কিশোর নজরুলের মানসপটে ছাপ রাখা ত্রিশালের ছায়া পরিব্যাপ্ত বৃহত্বঙ্গে গিয়ে পতিত হয়েছে।