ইনাজুর চোখে বৌদ্ধ রবীন্দ্রনাথ

ইনাজুর চোখে বৌদ্ধ রবীন্দ্রনাথ

প্রবীর বিকাশ সরকার
জাপানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক গুণমুগ্ধ ভক্ত এবং গবেষক ছিলেন কিংবা আছেন তেমনি অধ্যাপক ইনাজু কিজোও (১৯০২-১৯৯২) অন্যতম প্রধান। তিনি ছিলেন স্বনামধন্য তামাগাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ড. ওবারা কুনিয়োশি তিনিও ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদা শান্তিনিকেতনের মতো ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্বে।

আদিবেদ, বৌদ্ধধর্ম, প্রাচ্যদর্শন, নীতিশ্রাস্ত্রে পন্ডিত অধ্যাপক ইনাজু ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম, বৌদ্ধদর্শন, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস, প্রাচ্যবিদ্যা সম্পর্কে অনেক মূল্যবান গ্রন্থাদি রচনা করেছেন। অবিভক্ত বাংলা এবং ঠাকুর বংশ সম্পর্কে তাঁর ছিল বিপুল আগ্রহ, তাই ১৯৫৬ সালেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বংশের প্রবাদপুরুষ, ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রধান প্রবর্তক মহির্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী অনুবাদ করেছেন। জাপানে ঠাকুর বংশকে জানতে হলে এই গ্রন্থটি একটি আকরগ্রন্থ বলে বিবেচিত বিধায় ১৯৮৯ সালেও পুনরায় মুদ্রিত হয়েছে। ভক্তিভরে লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এবং অনুবাদ করেছেন তাঁর বহুপঠিত ‘বৌদ্ধধর্ম’ নামক বিখ্যাত প্রবন্ধ, গীতিনাট্য ‘বসন্ত’। আরেক রবীন্দ্রভক্ত অধ্যাপক ইয়ামাগুচি কিয়োশির সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন ইংরেজি প্রবন্ধ ‘মাই স্কুল’, ‘ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি’, ‘সাধনা’, ‘The religion of man with the cycle of spring & Gitanjali’ প্রভৃতি।

১৯৬১ সালে জাপানে ঘটা করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন করা হয়। সেই সময় বিস্তর রবীন্দ্ররচনা অনূদিত হয় বাংলা ও ইংরেজি থেকে। সেগুলো রবীন্দ্রস্মারক গ্রন্থে গ্রন্থিত আছে। সেখানেও অধ্যাপক ইনাজু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছেন। জাপানি ভাষায় প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলির অষ্টম খন্ডেও তাঁর রবীন্দ্রঅনুবাদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে জাপানি ভাষায় প্রকাশিত ‘সাচিয়া’ বা ‘সত্য’ নামক ২২টি ট্যাবলয়েড সাইজ বুলেটিনের তিনি ছিলেন প্রধান সম্পাদক। এই জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে ১৯৫৮ সালেই উদ্যোগ গৃহীত হয়। পরের বছর ১৯৫৯ সালে টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘বুলেটিন ১’-এ অধ্যাপক ইনাজু কিজোও ‘তাগো-রু তো বুক্কিয়োও’ বা ‘টেগোর এবং বৌদ্ধধর্ম’ নামে একটি ক্ষুদ্র রচনা লিখেন এটারই বাংলা অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখন, কোন সুবর্ণ সময়ে বুদ্ধের প্রতি হৃদয় সঁপে দিলেন অথবা কী ধরনের পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন এসব ভালো করে জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এসব বিষয়ে কিছু বলেননি, আবার তাঁর তরুণকালের রচনায় সুনির্দিষ্ট করে বললে চল্লিশের আগে শান্তিনিকেতনে নতুন শিক্ষকজীবন শুরুর আগের রচনায় বুদ্ধের প্রভাবজনিত ইঙ্গিত পযন্ত— পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তবে বাংলা ভাষায় কথিত এবং লিখিত রচনাদিতে থাকতে পারে। কিন্তু ইংরেজিতে প্রকাশিত রচনায় দেখা যাচ্ছে না। এমনও হতে পারে সেসময় বুদ্ধের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়াটা স্বাভাবিক বলেই ধারণা হয়।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ খুব অল্পবয়সে ঘটেছিল। ‘বাল্যস্মৃতি’ গ্রন্থে বিশ বছর বয়সের সময় এক সকালের পরিবর্তনজনিত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, যেটা বুদ্ধস্মরণেই গভীর শরণ নেওয়া এবং সেটাই হয়েছে তাঁর নতুন জীবন। তারপর মানুষের দুঃখশোকের মধ্য দিয়ে তাঁর ধর্মীয় চেতনাবোধ গভীরতর হয়; চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে সেই সময়কার চিঠিপত্রে মোটেই স্থির থাকতে না পারার একটা অস্থিরতা দেখা যায়। কিছু একটা করার শুভ ইচ্ছার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেটাই কয়েক বছর পর তাঁকে শান্তিনিকেতনের দিকে ধাবিত করেছিল মনে হয় ঠিকই কিন্তু এই সময়টায় রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ের সহায় হয়েছিল বুদ্ধ না হয়ে মহির্ষি পদবিধারী তাঁর পিতা (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) এবং প্রাচীন পবিত্র গ্রন্থ উপনিষদ। বিশেষ করে পিতৃদেবের প্রভাব ছিল বিশাল।

সেই আধ্যাত্মিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করেই কখন থেকে যেন বুদ্ধ এবং তাঁর শিক্ষা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে জায়গা করে নেয়। যা মানুষের অন্তরের পথচলায় অনিবার্য পথনির্দেশিকা বলে মনে হয়। তেপান্ন বছর বয়সে প্রকাশিত ‘সেইমেই নো জিৎসুগেন’ (Sadhana: The Realisation of Life) গ্রন্থে বুদ্ধের শিক্ষা ইতোমধ্যেই তাঁর ভেতরের মানব এবং চিন্তার মৌলিকত্ব গঠনের জন্য উপলব্ধি আর সহানুভূতির উন্মেষ ঘটায়। একদা মহাযান বৌদ্ধধর্মের জন্মদাত্রী ভারতের ঐতিহ্য এভাবে রবীন্দ্রনাথের ওপর নতুন করে জীবন্ত সত্যরূপে প্রকাশিত হয়েছে। তাই তো জীবনসায়াহ্নে দেহমনে বুদ্ধের প্রতি নিবেদিত প্রতিমূর্তিকে উপস্থাপিত করছেন। বুদ্ধগয়ায় জনৈক জাপানি জেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে একরাতের কথা তুলে ধরা একাংশ বিশেষভাবে গভীর অনুভূতিজাত। রবীন্দ্রনাথের মহাজীবনের শেষপ্রান্ত অতিক্রম করার অবস্থানটি ‘বুদ্ধনং শরণং গচ্ছামি’তে সমর্পিত হওয়া আমার ভেতরেও একই চিত্তকে আহ্বানের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলে। শুধু তাই নয়, সেটা জাপানের ভেতরে ঘুমন্ত ওই একই আধ্যাত্মিকতাকে আহ্বানের মধ্য দিয়ে একদিন জাগিয়ে তুলবে নিশ্চয়ই। আমি সেটাই প্রত্যাশা করি।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *