মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসা

মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসা

তালহা হাসান
মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসা মুমিনের কর্তব্য। ভালোবাসার কথা শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, বরং আচার-ব্যবহার ও কাজকর্মে এর বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। একজন মুমিনের কাছে মা-বাবা, সন্তান-সন্ততিসহ আপনজনদের চেয়ে তাঁকে বেশি ভালোবাসতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন, যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও আল্লাহর পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, স্ত্রী ও পরিবার, এবং যে সম্পদ তোমরা উপার্জন করেছ, যে ব্যবসা-বাণিজ্যে তোমরা মন্দার আশঙ্কা করছ, যে বাসস্থানকে তোমরা ভালোবাসো, তাহলে তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, মহান আল্লাহ বিশৃঙ্খল জাতিকে সুপথ দেখান না।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ২৪)
উল্লিখিত আয়াতটি ব্যক্তির কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সর্বাধিক ভালোবাসা আবশ্যক হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
ঈমান পূর্ণ হয় যাঁর ভালোবাসায়; সর্বাধিক নবিপ্রেম না থাকলে ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। তখন নবীজি (সা.) উমর (রা.)-এর হাত ধরে রেখেছিলেন।
উমর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমার কাছে সব কিছু থেকে প্রিয়, তবে আমার প্রাণ ছাড়া। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘না, হে উমর। ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় না হই। এরপর উমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ, এখন হয়েছে।
আল্লাহর শপথ, আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়ে বেশি প্রিয়। তখন নবীজি (সা.) বললেন, হ্যাঁ, উমর। এবার ঠিক আছে। (বুখারি, হাদিস ৬৬৩২)
মহানবীর প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসা বর্ণনাতীত। বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়।
নির্মমভাবে হত্যার সময় খুবাইব বিন আদি (রা.)-এর মুখে মহানবী (সা.)-এর প্রশংসামূলক বাক্য স্মরণীয় ঘটনা। চতুর্থ হিজরিতে রাজি হত্যাযজ্ঞের সময় খুবাইব বিন আদি (রা.) বা জায়েদ বিন দাসিন্নাহ (রা.)-কে বন্দি করা হয়। কুরাইশের কাফিররা তাদের ক্রয় করে হত্যার জন্য নিয়ে যায়। মৃত্যুর আগমুহূর্তে আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করে, আল্লাহর শপথ, হে জায়েদ, তুমি কি ভালোবাসো যে মুহাম্মদ এই মুহূর্তে আমাদের মধ্যে তোমার স্থানে থাকবে এবং আমরা তার শিরশ্ছেদ করব? তখন ওই সাহাবি বলেছিলেন, আল্লাহর শপথ, আমি মোটেও ভালোবাসি না যে মুহাম্মদ আমার এই স্থানে থাকবে এবং তিনি কাঁটাবিদ্ধ হয়ে কষ্ট পাবেন আর আমি পরিবার নিয়ে বসে থাকব। তাঁর কথা শুনে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, আমি এমন কোনো মানুষ দেখিনি, যে অন্যকে এমনভাবে ভালোবাসে, যেভাবে মুহাম্মদকে তার সঙ্গীরা ভালোবাসে। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ৩/১৬০)
যুদ্ধের পর আনসারি নারীর জিজ্ঞাসা : সা‘দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, ওহুদ যুদ্ধের দিন বনু দিনার গোত্রের এক আনসারি নারীর স্বামী ও ভাই শহীদ হন। সবাই ওই নারীকে তাঁদের মৃত্যুর খবর জানাচ্ছিল। তখন সেই নারী জিজ্ঞাসা করছিলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কী অবস্থা? সবাই বলছিল, হে অমুকের মা, তিনি ভালো আছেন। ওই নারী বলল, তিনি কোথায়, আমাকে দেখিয়ে দিন। অতঃপর সবাই ইশারা করে দেখিয়ে দেয়। রাসুল (সা.)-কে দেখে সেই নারী বললেন, ‘আপনার পর সব বিপদই তুচ্ছ।’ (তারিখে তাবারি : ২/৫৩২)
মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা পালন : হুদায়বিয়ার বছর উরওয়া বিন মাসউদ আস-সাকাফি মক্কার কুরাইশ প্রতিনিধি হিসেবে মহানবী (সা.)-এর কাছে আলোচনার জন্য আসেন। তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাহাবিদের আচার-ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেন। মক্কায় কুরাইশদের কাছে ফেরার পর তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, হে আমার জাতি, আমি কায়সার, কিসরা, নাজ্জাশিসহ অনেক রাজা ও বাদশাহর দরবারে গেছি। আল্লাহর শপথ, আমি এমন কোনো রাজা দেখিনি, যাঁকে তাঁর সঙ্গীরা এতটা সম্মান করে, যেমন মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর সঙ্গীরা করে থাকেন। আল্লাহর শপথ, তিনি থুতু ফেললে তা কোনো সাহাবির হাতে পড়ে। অতঃপর তা তাঁদের গায়ে-মুখে মেখে নেন। তিনি তাঁদের আদেশ দিলে তাঁরা তা দ্রুত পালন করেন। তিনি অজু করলে সাহাবিদের মধ্যে তাঁর অজুর পানি নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তিনি কথা বললে সাহাবিরা নিশ্চুপ হয়ে তা শোনেন। এমনকি তাঁর সম্মানে তাঁরা তাঁর চেহারার দিকেও তাকান না। তিনি তোমাদের কাছে ভালো প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তোমরা তা মেনে নাও।’ (বুখারি, হাদিস : ২৭৩৩)
ওহুদ যুদ্ধের ভয়াবহ মুহূর্তে আবু তালহা (রা.) ঢাল হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর থেকে হামলা প্রতিহত করছিলেন। একপর্যায়ে রাসুল (সা.) উঁকি দিয়ে দেখতে গেলে আবু তালহা (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক, আপনি উঁকি দেবেন না। নতুবা আপনার গায়ে তীর এসে লাগবে। আমার বুক আপনার জন্য উৎসর্গিত। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৩৮১১)
আমর ইবনুল আস (রা.) মৃত্যুশয্যায় বলেছেন, এই পৃথিবীতে আমার কাছে রাসুল (সা.)-এর চেয়ে বেশি প্রিয় ও মহান কেউ নেই। আমার অন্তরে তাঁর প্রতি সম্মান এত বেশি ছিল যে আমি তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না। আমাকে তাঁর দৈহিক অবয়বের বর্ণনা দিতে বলা হলে আমি পারব না। কারণ আমি দুচোখ ভরে তাঁকে দেখতে পারিনি। (মুসলিম, হাদিস ১৯২)

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *