মুফতি সাইফুল ইসলাম
বাঙালি মুসলিম সমাজ কখনোই ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে অন্তরায় হিসেবে দেখেনি। যেসব বাঙালি মুসলিম কবি, লেখক, গবেষক ও সাহিত্য চর্চাকারীদের অবদানে আজ বাংলা-সাহিত্য এতটা সমৃদ্ধ আর বিকশিত হয়েছে, তাদের অন্যতম কয়েকজন হচ্ছেন-শাহ মুহাম্মদ সগীর, দৌলত উজির, সৈয়দ সুলতান, আলাওল, কায়কোবাদ, শেখ ফয়জুল্লাহ প্রমুখ। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ফররুখ আহমদ, মীর মশাররফ হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, শেখ আব্দুর রহিম, আল মাহমুদ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃতি ও দিগন্তজয়ী ঔজ্জ্বল্যে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
আমার আজকের নিবন্ধে আলোকপাত করতে চাই বাংলা ভাষার কাব্যচর্চায় অগ্রসেনানি ত্রয়োদশ শতকের মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মাদ সগীরকে নিয়ে।
দাবি করা হয়, তিনিই প্রথম মুসলিম, যিনি বাংলা ভাষায় কাব্যগীতি রচনা করে মুসলিম সমাজে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। শুরুর দিকে মুসলিমদের ধর্মকথা শোনানোর উদ্দেশ্যে কাব্য রচনায় প্রয়াসী হলেও ক্রমান্বয়ে তাঁর কাব্য হয়ে ওঠে শিল্পমূল্যেও অনেক সমৃদ্ধ।
ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে শাহ মুহাম্মাদ সগীর সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য না পেলেও বিভিন্ন মনীষীর দেওয়া ভাষ্যমতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে তিনি ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিক থেকে চতুর্দশ শতকের প্রথম দিকে কাব্য চর্চায় নিবেদিত ছিলেন। দাবি করা হয়, বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে তিনিই প্রাচীনতম। গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৩-১৪০৯ খি«.) ‘ইউসুফ-জুলেখা’ প্রণয়োপাখ্যান (কাব্যগ্রন্থ) রচনা করে সমকালীন খ্যাতির শীর্ষে তুলে আনেন নিজেকে। ইউসুফ-জুলেখা কাব্য তিনি বাংলা ভাষায় ধর্মীয় উপাখ্যান ও পটভূমি বর্ণনা করতে চাইলেও তাতে মানবিক প্রেমোপাখ্যানও বেশ চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সভা কবি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেও বিভিন্ন সূত্রে উঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘কবিতা সংগ্রহ’ জুলাই ১৯৯০ সংখ্যার ৪৩৮ পৃষ্ঠার ভাষ্যমতে, ‘শাহ মুহাম্মাদ সগীরের কাব্যে কাব্যরস পরিবেশন অপেক্ষা ধর্মীয় প্রেরণা সৃষ্টির প্রচেষ্টাই বেশি পরিলক্ষিত হয়। সে যুগে বাংলা ভাষায় রসাশ্রয়ী কাব্যিক ধর্মকাহিনি রচনা করার মধ্যে কবির সৎ সাহসের পরিচয় মেলে। মুসলিম ধর্ম গ্রন্থের কিছুটা অনুসরণে কাহিনি কাব্যটি রচিত হলেও তাতে বাংলাদেশ ও বাঙালি জীবনের বৈশিষ্ট্য বহুলাংশেই প্রকাশ পেয়েছে।’
বাংলা পিডিয়া (২য় সংস্করণ) এর তথ্যমতে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ উপাচার্য ড. এনামুল হক কবি শাহ মুহাম্মাদ সগীরকে চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে বিবেচনা করেছেন। কারণ তার কাব্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। আমরা এ কথা জোর দিয়েই বলতে পারি যে শাহ মুহাম্মাদ সগীরই প্রথম ব্যক্তি, যিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে আরবি-ফারসি সাহিত্যের জগদ্বিখ্যাত নানা কাব্য ও ছন্দকে এ দেশের পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
সময়ের সেরা এ কবির ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি না। কারণ ইন্তেকালের আনুমানিক ছয় শ বছরেরও বেশি সময় পর বাঙালি গবেষকগণ তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। ফলে একজন অনন্য মুসলিম কবি সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই এখনো জানি না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনি বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের নিজ ভাষায় ধর্মীয় প্রণয়োপখ্যানে সিক্ত করে বাস্তবতাবর্জিত পুঁথিসাহিত্য থেকে পাঠককে প্রকৃত সাহিত্য রসে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস সমৃদ্ধির স্বার্থে হলেও শাহ মুহাম্মাদ সগীরের জীবন এবং কর্ম নিয়ে আরো ব্যাপকতর গবেষণা প্রয়োজন।