শাহীনুর রেজা
ঊনবিংশ শতকের শেষ বা বিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকের বিস্তৃৃত রাজনৈতিক পটভূমিতে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। এই সময়ের পটভূমিতে নজরুল লালিত হন এবং তার সামাজিক রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে। বিশেষ করে, মহাযুদ্ধোত্তর বিভিন্ন আন্দোলন নজরুল ইসলামকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে তিনি কিছু কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। রাজনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিরা সাধারণত আন্দোলন এবং সভা-সমিতি, মিছিল-মিটিং কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের চাওয়া-পাওয়াকে তুলে ধরেন। নজরুলের বেলায় বাড়তি যোগ হয়েছে তার ক্ষুরধার লেখনী। এজন্য তাকে অন্যান্যের তুলনায় অনেক বেশি রাজরোষানলে পড়তে হয়েছে। মুক্তিসংগ্রামের ভাবপ্রবণ আদর্শ তাকে বেশি প্রভাবিত করেছে। তাই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অগ্রনায়কদের নিয়ে (যেমন-লোকমান্য তিলক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রমুখ) তিনি কবিতা, গান, প্রবন্ধ রচনা করেন। কবির মনে ঢেউ সঞ্চার করে বিদেশি বিপ্লববাদ আন্দোলনের ইতিহাসও। তার কবিকল্পনাকে উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত করেছিল গোপীনাথ সাহা, ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য সেন, যতীন দাস প্রমুখ শহিদের দুঃসাহসিক কার্যকলাপ। এছাড়া নজরুল কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বারাও প্রভাবিত হন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফ্ফর আহমদ নজরুলের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন বলে স্বাভাবিকভাবে এ দলের অনেক কিছু তাকে প্রভাবিত করে। তার লেখক ও রাজনৈতিক জীবনকে বলিষ্ঠ করে।
দেশের শৃঙ্খলমুক্তির জন্য সন্ত্রাসবাদীদের বিপ্লবাত্মক প্রয়াস নজরুলের চিত্তে রেখাপাত করেছিল। স্বাধীনতা তার কাছে ছিল শোষিত মানুষের মুক্তি ও মেহনতি মানুষের প্রাপ্যের অধিকার। তার বিপ্লবের উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের মনের স্বাধীনতার আকাংখা জাগরিত করা, সে স্বাধীনতা মানবমনের সর্বোদয় অর্থাৎ ধর্মে, সমাজে, অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতা।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে যে বিদ্রোহী সত্তা, তার রচনার পরতে পরতে যে শোষণমুক্ত সমাজ, শৃঙ্খলমুক্ত কর্মজীবী মানুষ, স্বাধীন দেশের উর্বর জমি ইত্যাদি নানা মানবতাবাদবিষয়ক ধারণায় তিনি ঋদ্ধ হয়েছিলেন ১৯১৭ সালে সিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের কাছে। নিবারণচন্দ্র ঘটক শুধু নজরুলের শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন রাজনৈতিক দীক্ষাগুরুও। নিবারণচন্দ্র স্কুলজীবনে নিখিল ভারত বিপ্লবী সংগঠনের কর্মী ছিলেন। তার মাসিমা প্রথম নারী বিপ্লবী দু-কড়ি বালা দেবী। নিবারণ ঘটক দেশের স্বাধীনতা ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন। †সই স্বপ্নের বীজ তিনি নজরুলের মধ্যে বপন করেছিলেন।
সিয়ারশোলের পরের অধ্যায় নজরুলের সৈনিক জীবন। সেখানে তিনি অবসরে বিপ্লবী পত্রপত্রিকা পড়তেন, রাজদ্রোহমূলক কাগজপত্র আনতেন, আনতেন সরকারনিষিদ্ধ পত্রিকা, সংবাদ রাখতেন আইরিশ বিপ্লব, রুশ বিপ্লবের। তার কাগজপত্রের তলায় চাপা থাকত সিডিশান কমিটির রিপোর্ট। গোপনে তিনি সেসব পড়তেন। এসব কিছুই ছিল কাজী নজরুলের রাজনৈতিক সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ।
পল্টন থেকে ফিরে এলে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে মুজাফ্ফর আহমদ একদিন নজরুলকে বললেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আপনার কর্তব্য কী বলে আপনি মনে করেন? শুধুই সাহিত্য করবেন, নাকি রাজনীতিও করবেন?’ নজরুল পরিষ্কার ভাষায় জানালেন, ‘রাজনীতি যদি না করব তো যুদ্ধে গিয়েছিলাম কেন।’ নজরুল এবং মুজাফ্ফর আহমদের কথাবার্তায় রাজনীতিতে নজরুলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল যখন প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করেন এবং তার রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শহর ও মফস্বলে পরিব্যাপ্তি হয় তখন দেশে স্বাধীনতার জন্য উত্তাল আন্দোলন। ব্রিটিশের শাসন আর ভারতবাসী মানতে চায় না। রাজনীতিতে ‘কংগ্রেস’ নামক রাজনৈতিক দলের নেতা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসুসহ আরো অনেকে।
অন্যদিকে বিপ্লবাদীরা বোমা মেরে, গুলি করে ইংরেজদের দেশ ছাড়া করতে চায়। ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে সন্ত্রাসবাদী বলে গালাগাল দিত। নজরুলকে এ দলের লোকেরা বেশি ভালোবাসত। নজরুলও তাদের ভালোবাসতেন। ব্রিটিশদের নিয়ে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন-‘এ দেশ ছাড়বি কি না বল/নইলে মারের চোটে হার করিব জল।’
অনেক বিপ্লববাদীদের ব্রিটিশ সরকার ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলেছে। কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা বিপ্লববাদীদের সরাসরি আঘাত করাটা পছন্দ করতেন না। তারা ব্রিটিশদের একধরনের তোষামোদি করতেন। নজরুল এই তোষামোদি পছন্দ করতেন না। তাই কংগ্রেসের প্রতি তার আস্থা ছিল না। তিনি সরাসরি আঘাত করাটাই চাইতেন, নইলে ব্রিটিশ ভারত ছাড়বে না।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে মহাত্মা গান্ধী গিয়েছিলেন হুগলিতে। সেখানকার চাঁদনীঘাটে বিশাল শামিয়ানা খাটিয়ে মহাসভার ব্যবস্থা করলেন হুগলি স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীরা। গান্ধীজিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ‘বাঙলায় মহাত্মা’ শিরোনামে নজরুল গান লিখলেন-‘আজ না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে/ ঐ কংস কারার দ্বার ঠেলে,/ আজ শব-শ্মশানে শিব নাচে ঐ/ ফুল ফুটানো-পা ফেলে।’
গান্ধীজিকে নজরুল প্রথম দিকে খুব ভালোবাসতেন। সে কারণেই এ প্রশংসা করেন। কিন্তু তিনি যখন পরবর্তী সময়ে অহিংস আন্দোলনের ডাক দেন তখন নজরুল তার পথ পরিহার করেন। নজরুল উপলব্ধি করেছিলেন যে, গান্ধীজির আন্দোলনে দেশে স্বাধীনতার পথ সুগম হবে না। কারণ তিনি বিপ্লববাদী আন্দোলনকে ইংরেজের সুরে গণ্য করেন সন্ত্রাসবাদী অান্দোলন হিসেবে। শুধু তা-ই নয়, বিপ্লবী ভগত সিংয়ের ফাঁসির জন্য গান্ধীজি সই করেছিলেন। নজরুল তখন গান্ধীজির সমালোচনা করেন।
গান্ধী চান স্বরাজ। অর্থাৎ স্বাধীনতা নয়, স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু নজরুল চান ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি গান্ধীজির পথকে পরিহার করে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চান। ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে নজরুল লিখলেন- ‘স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে একেক মহারথী একেক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।’
আগেই বলেছি, নজরুল প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করেন ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। নজরুল এই সময়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগে্রস কমিটির সদস্য হন। নজরুলের অন্যতম রাজনৈতিক সহকর্মী হেমন্তকুমার সরকার কংগ্রেসের সভ্য হওয়া সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলনে অধিকতর উৎসাহী ছিলেন। জেলে ও চাষিদের অনেক সভা-সমিতিতে তারা যোগ দিতেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার, কুতুবউদ্দীন আহমদ ও শামসুদ্দীন হুসয়নের উদ্যোগে। কলকাতায় একটি নতুন পার্টি গঠিত হয়। পার্টির নাম ‘ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির অন্তর্ভুক্ত মজুর স্বরাজ পার্টি’ (The Labour Swaraj Party of the Indian National Congress) বা ‘শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দল’। এই দলের প্রথম ইশতেহার কাজী নজরুল ইসলামের দস্তখতে প্রকাশিত হয়েছিল। পার্টি গঠন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখপাত্ররূপে ‘সাপ্তাহিক লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। ২৬ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে লাঙল-এর প্রথম খন্ড বিশেষ সংখ্যা প্রকশিত হয়।
নজরুলের পরিচালনায় ‘লাঙল’ পত্রিকা নিয়ে ১০ আগস্ট লেলিনগ্রাদের প্রাচ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আলী দাউদ আলী দত্ত নামে পরিচিত বাংলার প্রখ্যাত বিপ্লবী প্রমথ দত্ত একটি পত্রে লেখেন, ‘ভারতের অত্মোৎপন্ন সম্পদে বঞ্চিত সম্প্রদায়ের (Proletariat) জাগরণশীল শে্রণি চৈতন্যের লাঙল-ই প্রথম মুখপত্র।’
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগরের বাড়ি থাকা অবস্থায় পূর্ববঙ্গ থেকে নজরুল ইসলাম কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে প্রার্থী হলেন। ৩১ অক্টোবর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকা সফর করেন এবং প্রায় পুরো নভেম্বর মাস তিনি ময়মনসিংহ, বাকেরগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার নির্বাচনি জনসংযোগ করেন। কিন্তু ঐ সময়ে নজরুলের পক্ষে পূর্ব বাংলার কোনো মুসলমান আসন থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করা কঠিন ছিল। কারণ গোঁড়া মুসলমান সম্প্রদায় ইতিপূর্বেই তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। নজরুল নিজেও এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। ২৯ নভেম্বর ১৯২৬ তারিখে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা যায় যে, নজরুল নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন এবং তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভ করেন বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী ও টাঙ্গাইলের জমিদার আবদুল হালিম গজনবী।
এরপর ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষ সপ্তাহে কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজাফ্ফর আহমদ একটি কৃষক সম্মেলনে যোগ দিতে কুষ্টিয়া যান। কলকাতা থেকে আবদুল হালিম, গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ফিলিপ স্প্র্যাট ও ত্রিপুরা থেকে ওয়াসিমউদ্দিন ঐ সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের প্রতিনিধিদের কাছে নজরুল ছিলেন অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সেখানে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের পরামর্শক্রমে বঙ্গীয় কৃষক লীগ-কৃষকদের একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু ২০ মার্চ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় মুজাফ্ফর আহমদ গ্রেফতার হলে তা সম্ভব হয়নি। মুজাফ্ফর আহমদ বলছেন-‘কুষ্টিয়ার ঐ সভাতেই আমি নজরুলের সঙ্গে রাজনীতিক মঞ্চে শেষ দাঁড়িয়েছিলাম।’
রাজনীতিতে সার্থক না হলেও নজরুলের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। এর প্রথম কারণ হিসেবে বলা যায় (বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে গভীর নৈকট্য। দ্বিতীয় কারণ: বিভিন্ন শে্রণির ব্যতিক্রমী কাব্যধারা এবং তৃতীয় ও বলিষ্ঠ কারণ: কবির রাজনৈতিক দর্শন, দেশ ও মানুষের মুক্তির সংগ্রামের দর্শন।