ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়)
নিপাহ ভাইরাস কী?
নিপা ভাইরাস একটি জুনোটিক ভাইরাস। যে ভাইরাস মূলত বন্যপ্রাণীর দেহে থাকে বা বন্যপ্রাণিতে রোগ সৃষ্টি করে এবং কদাচিৎ তা বন্যপ্রাণি থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হয়ে রোগ সৃষ্টি করে, সেই ভাইরাসকে বলা হয় জুনোটিক ভাইরাস (Zoonotic virus) এবং সেই ভাইরাস দ্বারা সংগঠিত রোগকে বলা হয় জুনোটিক ডিজিজ (Zoonotic disease)।
নিপা ভাইরাস মূলত বিশেষ এক প্রজাতির বাদুড়ের দেহে থাকে। বাদুড় হতে মানবদেহে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়। প্রায় প্রতি বছর শীতকালে এশিয়ার কিছু অঞ্চলে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে এই নিপাহ ভাইরাস এর প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার ‘সাঙ্গাই নিপাহ’ গ্রামে সর্বপ্রথম এই ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। সেই গ্রামের নামানুসারে এই ভাইরাসটির নামকরণ করা হয় নিপাহ ভাইরাস।
এই ভাইরাস মানবদেহে কি ক্ষতি করতে পারে?
মানবদেহে এই ভাইরাস সংক্রমণের সাধারণত ৪ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে মৃদু থেকে তীব্র পর্যায়ের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণে মানবদেহে শ্বাস-তন্ত্রের প্রদাহ, মস্তিষ্কে প্রদাহ হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর, মাথা ব্যথা, কাশি, গলা ব্যথা, শ্বাস-কষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই ভাইরাস দ্বারা মস্তিস্ক আক্রান্ত হলে তা মারাত্মক জটিলতা তৈরি করে। সেক্ষেত্রে রোগীর খিঁচুনি হয়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে এমনকি রোগী মারা যেতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুহার অনেক বেশি। আক্রান্ত রোগীদের সাধারণত শতকরা ৪০ থেকে ৭৫ জন মারা যায়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা সুস্থ হয় তাদের বেশিরভাগই পরবর্তী সময়ে খিঁচুনি রোগসহ নানা ধরনের স্নায়ুগত জটিলতায় ভোগে।
এই রোগ কীভাবে ছড়ায়?
– সংক্রমিত প্রাণি যেমন-বাদুড়, শূকর ইত্যাদির সরাসরি সংস্পর্শে আসলে বা এদের লালা, রক্ত, মলমূত্রের সংস্পর্শে এলে একজন সুস্থ মানুষ সংক্রমিত হতে পারে।
– বাদুরের লালা বা মলমূত্র দ্বারা সংক্রমিত কোন খাবার যেমন- খেজুরের কাঁচা রস, বাদুরের আধ খাওয়া ফল (যেমন- পেয়ারা, বড়ই ইত্যাদি) খেলে একজন সুস্থ মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। শীতকালে খেজুরের গাছে হাড়ি লাগিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। সেই হাড়ি থেকে অনেক সময় বাদুড়ও রস পান করে। ফলে বাদুড়ের লালার মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস হাড়ির রসে মিশে যায়। বাদুড়ের প্রস্রাব থেকেও নিপাহ ভাইরাস সেই হাড়ির রসে মিশতে পারে।
– কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে তার হাঁচি কাশির মাধ্যমে বা একই পাত্র থেকে পান করলে লালার মাধ্যমে অন্য ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
আরটি-পিসিআর (RT-PCR) পরীক্ষার মাধ্যমে মানবদেহে এই রোগের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। তবে এই পরীক্ষাটি দেশের সকল জায়গায় হয় না। কোনো ব্যক্তি নিপাহ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে বলে ধারণা করলে তা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আইইডিসিআরকে জানাতে হয়। তারা তখন নিজ উদ্যোগে এই পরীক্ষাটি করে থাকে।
চিকিৎসা
নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো নির্দিষ্ট ঔষধ এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। সুতরাং প্রতিরোধই এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায়।
এই রোগ প্রতিরোধের উপায় কী?
শীতকালে খেজুরের কাঁচারস পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া বাদুড়ের আধ-খাওয়া ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে খেজুরের রস ফুটিয়ে পান করলে তা থেকে নিপাহ ভাইরাস ছড়ানোর আশংকা নেই। যে কোনো ফল ভালো করে ধুয়ে তার পর খেতে হবে। গাছ থেকে ফল পারার পর বা খেজুরের রস আহরণের পর হাত ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। নিপাহ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। উল্লেখ্য যে এই রোগের কোন টিকা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০১১ সালে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে এর ব্যবস্থাপনা, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় নির্দেশিকা জারি করে। এতে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ নির্দেশিকায় খেজুরের কাঁচা রসকে নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি
২০০১ সালে বাংলাদেশের মেহেরপুরে সর্বপ্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। সরকারের রোগ তত্ত, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর তথ্য অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই ভাইরাসের সংক্রমণে ৩২২ জন নিপাহ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ২২৯ জন। অর্থাৎ- আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর হার শতকরা প্রায় ৭১ ভাগ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর ২০০৩ সালে হয় নওগাঁয়। তবে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় আকারের প্রাদুর্ভাব হয় ফরিদপুর জেলায়, ২০০৪ সালে। সে বছর ফরিদপুরে নিপাহ ভাইরাসে ৩৫ জন আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যু হয়।
বিগত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন জেলায় যেমন- ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা, গাইবান্ধা, কুড়িন্ধ্রাম, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জে বিভিন্ন সময়ে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের দেশে টেরোপাসমিডিয়াস (Pteropusmedius) প্রজাতির বাদুড়কে এই নিপাহ ভাইরাসের বাহক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বাদুড়গুলো আকৃতিতে বেশ বড়।
নিপাহ ভাইরাস নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবেও প্রচার অনেক কম। টেলিভিশন বা গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রচারমূলক বিজ্ঞাপনও কম। গণমাধ্যমে প্রচার প্রচারনার মাধ্যমে জনসাধারণকে এই নিপাহ ভাইরাসের বিষয়ে সচেতন করা জরুরি।
[লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), সহকারী রেজিস্ট্রার, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]