ড. জাহিদ হোসেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই সময় নিট রিজার্ভ ছিল ৪০.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপর থেকেই রিজার্ভের স্ফীতি কমছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার রিজার্ভ থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর নিট রিজার্ভের পরিমাণ ১ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
রিজার্ভ হ্রাস পাওয়ার পেছনে মূলত দুই ধরনের কারণ কাজ করছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে ডলার আসে ডলার যায়। রপ্তানি বাণিজ্য, রেমিট্যান্স, বিদেশি বিনিয়োগ এবং ঋণের মাধ্যমে ডলার দেশে আসে। আর আমদানি এবং ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে ডলার দেশের বাইরে চলে যায়। রপ্তানির মাধ্যমে যে পরিমাণ ডলার দেশে আসে এবং আমদানির মাধ্যমে যে পরিমাণ ডলার দেশের বাইরে চলে যায়, এর ব্যবধানকে বলা হয় ব্যালেন্স অব পেমেন্ট। মার্কিন ডলার যদি বেশি পরিমাণে দেশে আসে আর আমদানির মাধ্যমে কম পরিমাণ ডলার বাইরে চলে যায়, তাহলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে উদ্বৃত্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর যদি মার্কিন ডলার দেশে কম আসে এবং সেই তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হয়, তাহলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতির সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে।
২০২১-২০২২ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনীতি অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হয়। সেই সময় আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি বেড়েছিল। বিশ্ববাজারে সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে আমাদের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সেই তুলনায় রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়নি। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। আর্থিক খাতে আমাদের উদ্বৃত্ত ছিল; কিন্তু বাণিজ্য ঘাটতি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সামগ্রিকভাবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। সেই চাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে যে কাজটি করেছে, তা হলো মার্কিন ডলার বাজারে বিক্রি। এর উদ্দেশ্য ছিল বাজারে মার্কিন ডলারের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে যে ব্যবধান আছে, তা কমিয়ে আনা। সেই সময় একটি ধারণা তৈরি হয় যে, বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিনিময় বৃদ্ধির কারণেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধারণা যে সঠিক ছিল না, তা বলা যাবে না। কারণ, স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার হ্রাস পাওয়া অথবা মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। প্রশাসনিকভাবে যেসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়, সরকার সেগুলোর মূল্য বাড়িয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য সরকার বাড়িয়েছে। এগুলো মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক চিন্তা করল, আমরা যদি মুদ্রার বিনিময় হার আরও বাড়তে দিই, তাহলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বৃদ্ধি পাবে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে মুদ্রার বিনিময় হার বেঁধে দেয়। কিন্তু সব খাতের জন্য একই বিনিময় হার কার্যকর করা হয়নি। রপ্তানির জন্য একরকম বিনিময় হার নির্ধারণ করা হলো; রেমিট্যান্সের জন্য আরেকরকম বিনিময় হার নির্ধারিত হলো। ইন্টার ব্যাংক মার্কেটের জন্য একরকম বিনিময় হার নির্ধারিত হলো; আমদানির জন্য আরেকরকম বিনিময় হার বেঁধে দেওয়া হলো। অর্থাৎ আমরা বহুমুখী বিনিময় হার পেলাম। সেই সময় মার্কিন ডলারের চাহিদা জোগানের চেয়ে বেশি ছিল, তাই সে অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করল। প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বাজারে মার্কিন ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখল। দ্বিতীয়ত, পণ্য আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলো। আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো। এলসি মার্জিন বাড়ানো হলো। আশা করা হয়েছিল, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে, তা কয়েক মাসের মধ্যে আরও ত্বরান্বিত হবে। আর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হলে তার প্রভাব স্থানীয় অর্থনীতির ওপরও পড়বে।
আন্তর্জাতিক বাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাড়ছিল, সেখান থেকে হ্রাস পাওয়া শুরু হলো। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য একসময় ব্যারেল প্রতি ১৩৯ মর্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পূর্বাবস্থায় নেমে আসে। সার, গম ও অন্যান্য পণ্যের মূল্যও কমতে শুরু করে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য এবং মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পেলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। অধিকাংশ উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পলিসি রেট ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক ফিন্যান্সিয়াল মার্কেটে যেসব লেনদেন করি, বিশেষ করে অফশোর মার্কেটগুলোয় যে রেট আমাদের লেনদেনকে প্রভাবিত করে, এর মধ্যে আগে ছিল লাইবর। এখন সিকিউর ওভার নাইট ফিন্যান্সিং রেট। করোনার আগে এর সুদের হার ছিল দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সেই সুদের হার বাড়তে শুরু করে। এখনো বাড়ছে, যদিও বৃদ্ধির গতি কিছুটা কমেছে। এখন সেই সুদের হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে।
আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য হ্রাস এবং মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমে যাওয়ার কোনো সুফল আমরা পাইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মডেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করার ফলে আমদানি কমেছে ঠিকই, কিন্তু বাজারে সরবরাহ ও জোগানের মধ্যে যে তারতম্য, সেখানে কোনো উন্নতি হয়নি। আমদানি কমেছে, ডলারের বিনিময় হার কমেছে। একই সঙ্গে ডলারের জোগানও কমেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলারের জোগান কমে যাওয়ার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার বিষয়টি। যদিও আমাদের চলতি খাতে ঘাটতি কমেছে; কিন্তু আর্থিক খাতে ঘাটতি বেড়েছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। দেখা যাচ্ছে, আর্থিক খাতে মাসের পর মাস ঘাটতি থাকছে। যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানির জন্য জাহাজীকরণ করা হয়, সেই অনুপাতে যদি রিসিট না বাড়ে, তাহলে ট্রেড ক্রেডিট বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেড ক্রেডিট অনেকটাই বেড়ে গেছে। রপ্তানি আয় যতটা সম্ভব বিলম্বে দেশে আনার একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, রপ্তানিকারকরা মনে করছেন, রপ্তানি আয় যদি বিলম্বে দেশে আনা যায়, তাহলে স্থানীয় মুদ্রায় বিনিময় হার বেশি পাওয়া যেতে পারে। কারণ, আগামী দিনে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার আরও বেড়ে যাবে। প্রতিমাসেই মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কিছু না কিছু বেড়েছে। আর কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় স্থানীয় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে মেটানো যেতে পারে। এটাকে পাচার বলা যাবে না। এটা হচ্ছে রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে না এনে বিলম্বে আনা। এটাকে মূলত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধির সুযোগ গ্রহণের প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি অংশ আছে, যার হিসাব মেলে না। এটা কখনো নেতিবাচক হয় আবার কখনো ইতিবাচক হয়ে থাকে। এটা সব দেশেই হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইদানীং দেখা যাচ্ছে এটা কখনোই ইতিবাচক হচ্ছে না। এখানে অর্থ পাচারের বিষয় থাকতে পারে।
ব্যাংকারদের যে দেনাগুলো ছিল তা তাদের পরিশোধ করতে হয়েছে। বিদেশে তাদের যে অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স ছিল তাও কমে গেছে। এ অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। যেমন মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়তে দেওয়া, অর্থ পাচার রোধ করা এবং বাজেট ঘাটতি কমানো। (অনুলিখন: এমএ খালেক)