এম রাশিদুল হাসান: আমাদের জানা আছে যে, আদি যুগে পৃথিবীতে মানুষ শুধু কৃষি বা প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত। ৩০০ বছর আগেও অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমান নির্ভর করত কৃষির ওপর। যুগে যুগে মানুষ তার জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কার করে আসছে। সেসব আবিষ্কার যখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক হারে ব্যবহত হয়েছে, তখনই অর্থিনীতিতে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আবিষ্কারের বাণিজ্যিকীকরণের ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, তাকে শিল্পবিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে বড় ধরনের তিনটি শিল্পবিপ্লব হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লটি এখন শুরু হয়েছে এবং মানুষ তাতে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে।
প্রথম শিল্পবিপ্লব: ১৭১০ সালে টমাস নিউকোমেনের স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। স্টিম ইঞ্জিনের সঙ্গে জেমস ওয়াটের নাম আমরা জানি। তিনি আসলে বাণিজ্যিকভাবে সফল প্রথম স্টিম ইঞ্জিনে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন করেছিলেন, যা বিশাল সফলতা এনে দেয়। এই বাষ্পীয় ইঞ্জিন আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে যান্ত্রিক যুগের সূচনা করে। ফলে কৃষির সঙ্গে যন্ত্রের ব্যবহার বা খনি থেকে লোহা ও কয়লা উত্তোলনের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি কৃষি থেকে শিল্পায়নে স্থানান্তরিত হয়।
দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব: ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কার আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পৃথিবীতে নিয়ে আসে। এই সময়ে বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণ শিল্প ও সমাজকে রূপান্তর করেছে, যা দ্বিতীয় শিল্পবিল্পবের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুতের অসাধারণ বহুমুখীতা এটিকে প্রায় সীমাহীন ব্যবহারের সুযোগ এনে দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পরিবহন, উষ্ণতা, আলো, যোগাযোগ, গণনা ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক শক্তি এখন আধুনিক শিল্প সমাজের মেরুদণ্ড।
তৃতীয় শিল্পবিপ্লব: কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন, অন্যদিকে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের উদ্ভাবন-এই দুইয়ে মিলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্মিলনে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবটি শুরু হয়। এই বিপ্লবটি ডিজিটাল বিপ্লব নামেও পরিচিত। ফলে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির জন্ম হয়। প্রযুক্তিটি বিশ্বটাকে হাতের মুঠোয় এনে দেয়, আমাদের মতো কম প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ ও অধিক জনসংখ্যার দেশ ও পৃথিবীর অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ পায়। লাখ লাখ মানুষ ঘরে বসেই কাজ করতে পারে, এমন সুযোগ এনে দেয়। এটি এমন একটি শিল্পবিপ্লবের সূচনা করে, যেখানে ভৌত অবকাঠামো ছাড়াও শুধু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা করা যায়। আমাদের আশপাশেই এর প্রচুর উদাহরণ আছে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানি, যেমন-পাঠাও বা উবার, যাদের নিজেদের গাড়ি না থাকলেও অন্যের গাড়ি দিয়ে ব্যবসা করছে; আবার ই-কমার্স কোম্পানিগুলো যাদের নিজেদের স্টক নেই, কিন্তু অন্যের পণ্য বিক্রি করে ব্যবসা করছে। এরকম অনেক ব্যবসায়ের উদাহরণ আছে, যারা শুধু তথ্য নিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে খুবই ভালো ব্যবসা করছে।
তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের মূল বিষয় হলো-যার কাছে তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের ভালো ব্যবস্থা আছে, তার হাতেই ব্যবসা। এরকম বড় বড় ব্যবসার উদাহরণ হলো-গুগল, ফেসবুক, এয়ারবিএনবি বা আমাজন ইত্যাদি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা ৪ওজ) শব্দটি প্রথম প্রবর্তন করেন একদল বিজ্ঞানী, যারা জার্মান সরকারের জন্য একটি উচ্চ প্রযুক্তিগত কৌশল তৈরি করছিলেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব ২০১৫ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ্যমে শব্দটিকে বৃহৎ পরিসরে উপস্থাপন করেন।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণাটা আরো অগ্রসর। এখানে তথ্য সংগ্রহ, সরবরাহ ও ব্যবহার হবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। এখানে সিদ্ধান্ত, যন্ত্র থেকে যন্ত্রে যোগাযোগ ও কর্মসম্পাদন হবে মানুষের সহযোগিতা ছাড়া। মানুষ শারীরিকভাবে যা করতে পারে না, তা-ও এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্ভব হবে।
আমাদের দৈনন্দিন কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার হিসেবে দেখলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যে প্রযুক্তিগুলোর সম্যক ব্যবহার হবে, এমন কিছু প্রযুক্তি ও তার ব্যবহার নিম্নরূপ হতে পারে।
স্মার্ট লাইফস্টাইল: আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) আরো অনেক কিছু করতে পারে। যেসব ডিভাইসে ইন্টারনেট সংযোগ আছে, তাকেই আইওটি ডিভাইস বলতে পারি। যেমন- আমাদের স্মার্ট ফোন। এই প্রযুক্তির উদাহরণ আমরা শিল্পবিপ্লবের তৃতীয় ধাপে দেখেছি। যেমন-উবার, অ্যামাজন, এয়ারবিএনবি ইত্যাদি যেখানে ডেটা দেওয়া হয় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। চতুর্থ শিল্পবিপ¬বের ধারণায় ডেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার হবে। যেমন-স্মার্ট হোম, স্মার্ট অফিস বা স্মার্ট ফ্যাক্টরি।
ধরা যাক, আপনি বাসায় নেই, এমন সময় কিছু একটা ঘটল আপনার বাসায় এবং নির্দিষ্ট কোনো যন্ত্র সেটি নির্ণয় করে তৎক্ষণাৎ আপনাকে জানাল এবং সমস্যাটির সমাধানও করল। যেমন-বাসায় ফিরে রেফ্রিজারেটর খুলে আপনার কিছু একটা খাওয়ার অভ্যেস আছে, কিন্তু রেফ্রিজারেটর দেখল সেটি নেই। রেফ্রিজারেটর নিজেই সেটির অর্ডার দিয়ে দিলো। অথবা ক্লিনিং রোবটটি আপনার অনুপস্থিতিতে ঘরটি পরিষ্কার করে রাখল। এর সবই এখন সম্ভব।
পরাবাস্তবতা: এটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পোশাকি নাম। কেমন হয় যদি ই-কমার্স সাইটে আপনার পছন্দ হওয়া একটি পোশাক বাসায় বসেই নিজের শরীরে পরে দেখতে পারেন? এখন তো চশমাসহ অনেক কিছুই পরে দেখা যায়।
রোবোটিকস: রোবট আস্তে আস্তে একঘেয়ে ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জায়গাগুলো দখল করে নেবে। কারখানায় মেশিন চালানো থেকে শুরু করে রাস্তায় গাড়ি চালানো সবই হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। রোগীর জটিল কোনো অপারেশন যেটি মানুষের জন্য কঠিন, রোবট তা সহজেই করে ফেলবে। জীবের যে কোনো অঙ্গ হয় তো যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হবে। ফসলের খেতে চাষ দেওয়া, বীজ বপন, রক্ষণাবেক্ষণ, ফসল তোলা সবই স্বয়ংক্রিয় রোবট নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র নিজেই করে ফেলবে।
এই যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন তার পেছনে থাকছে বিশাল তথ্যভান্ডার, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিমেষেই বিশ্লেষণ করে দেবে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) বা মেশিন লার্নিং পদ্ধতিতে তথ্য বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করে ফেলতে পারবে।
সাইবার সিকিউরিটি: বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে একটি দ্রুত ও রূপান্তরমূলক আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। ডিজিটাল অগ্রগতি এবং সাইবার জগতে নিয়মকানুন লঙ্ঘনের ক্রমাগত ঝুঁকির মধ্যে জটিল ইন্টারপে¬ সামগ্রিক আর্থিক খাতের জন্য ব্যাপক হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশ যখন ভিশন ২০৪১-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরিত করা, তার জন্য ডিজিটাল সম্পদ সুরক্ষিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করা বর্তমান সময়ের জন্য খুবই অপরিহার্য।
ক্লাউড কম্পিউটিং: ক্লাউড কম্পিউটিং শুধু একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয় বরং আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে চাওয়া ব্যাবসায়িক সংস্থাগুলির জন্য একটি কৌশলগত অপরিহার্য ব্যবস্থা। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে ডেটা ও অ্যাপি¬কেশনগুলো সঞ্চয়, পরিচালনা এবং অ্যাক্সেস করার জন্য একটি নিরাপদ, সাশ্রয়ী, নমনীয় এবং স্কেলযোগ্য সমাধান সরবরাহ করে, যা এটিকে ব্যাবসায়িক সংস্থাগুলোর জন্য একটি গেম-চেঞ্জার করে তুলেছে।
আমাদের করণীয় কী?
ডিজিটাল বাংলাদেশ বা মধ্যম আয়ের দেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, এটি এখন বাস্তবতা। কমিটি ফর ডেভেলমেন্ট পলিসির (সিডিপি) তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে যাওয়ার সবগুলো সূচক ভালোভাবে পার করেছে। এখন অফিশিয়ালি ঘোষণার অপেক্ষা। ঘোষণার পর বাংলাদেশ বেশ কিছু বিশ্ববাণিজ্যিক সুবিধা আর পাবে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে।
এছাড়া, রূপকল্প ২০৪১-শিল্পায়নের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন বাস্তবে রূপ দিতে হলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে গণসচেতনতা জরুরি। শিক্ষা, গবেষণা ও উৎপাদনে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ করে যাওয়া দরকার। আমাদের সন্তানকে ‘নেক্সট জেনারেশন টেকনোলজি’ যেমন-আইওটি, এআই, বিগডেটা, ভিআর, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, রোবোটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং ও ব¬কচেইন ইত্যাদি বিষয়ে পড়ানো উচিত। আর বিশাল জনগোষ্ঠীকে এসব প্রযুক্তির অন্তত ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা যায় সেই প্রচেষ্টা থাকতে হবে। তবেই আমরা শিল্পায়নের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন তথা রূপকল্প-২০৪১ অর্জন করতে পারব।