দেওয়ানবাগ ডেস্ক: করোনার ধাক্কা, ডলার সংকট এবং বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে শিল্প খাতের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বড় শিল্পের উদ্যোক্তারা শত প্রতিক‚লতা মোকাবিলা করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। তারা আগের ক্ষতি কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছেন।
কুটির, ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সামনে এগোতে পারছেন না। নানা প্রতিক‚লতায় পিছিয়ে পড়ছেন। সার্বিকভাবে বড় শিল্পে উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে, তবে ছোট মাঝারি ও অতি ক্ষুদ্র ও কটেজ শিল্পে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে শিল্পে উৎপাদন বাড়লেও চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ডলার সংকটের কারণে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ডলারের দাম ও আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি, দেশের বাজারে জ্বালানিসহ প্রায় সব ধরনের উপকরণের দায় বৃদ্ধিতে শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।
এতে শিল্পপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনিয়োগ মন্দায় নতুন শিল্প স্থাপন হচ্ছে কম। এতে ভাটা পড়েছে কর্মসংস্থানে। একদিকে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে মন্দা ও চড়া মূল্যস্ফীতিতে মানুষের আয় কমেছে। এসব কারণে পণ্যের বিক্রি যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে শিল্পে উৎপাদন। শিল্পপণ্যের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য যেমন আছে, তেমনই রয়েছে বিলাসী পণ্য। দুই খাতেই পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি কমেছে।
২০২০ সালে করোনার সংক্রমণের সময় থেকেই শিল্প খাতে মন্দা যাচ্ছে। ২০২১ সালে মন্দা কিছুটা পুনরুদ্ধার হলেও ২০২২ সালে ফেব্রæয়ারির শেষদিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়। এতে দেশের শিল্প খাতে সংকট আরও বেড়ে যায়।
এখন শিল্প খাতে বড় সংকট হিসাবে দেখা দিয়েছে ডলার ও মানুষের আয় কমে যাওয়া। ফলে ভোক্তারা এখন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। এতে কোম্পানিগুলোর পণ্যের বিক্রি কমে যাওয়ায় এখন কিছু পণ্যের দাম যেমন কমানো হয়েছে, তেমনই পণ্যের ওজন বা ইউনিট কমিয়ে কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে শিল্পে উৎপাদন কমেছিল ২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা কমার গতি রোধ করে বেড়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা দ্বিগুণ বেড়ে ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমছে।
গত জুলাইয়ে বেড়েছিল ২০ দশমিক ০৮ শতাংশ, আগস্টে তা কমে বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশে এবং সেপ্টেম্বরে সামান্য বেড়ে ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ উৎপাদন বেড়েছে। গত জুলাই-আগস্ট দুই মাসে শিল্পে উৎপাদন বেড়েছিল ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
জুলাই-সেপ্টেম্বরে তিন মাসে বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ জুলাই থেকে ধারাবাহিকভাবে শিল্পে উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
এর কারণ হিসাবে জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে শিল্পের মৌলিক কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল ও বাণিজ্যিক কাঁচামাল আমদানি কমেছে।
এ কারণে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে রপ্তানিকারকদের নিজস্বভাবে ডলারের সংস্থান তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানি করতে পারে। কিন্তু বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের মধ্যে যাদের রপ্তানি নেই, তারা ডলারের সংস্থান করতে পারছে না। ফলে আমদানির এলসিও খুলতে পারছে না। ব্যাংকও চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান দিতে পারছে না।
এমন শিল্পই এখন বড় সংকটে পড়েছে বেশি। অতি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলোর নিজেদের কাঁচামাল আমদানির সক্ষমতা নেই। তারা বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে। তাদের চাহিদা মেটাতে বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা এসব কাঁচামাল আমদানি করে। তারা ডলার সংকটের কারণে পারছে না এলসি খুলতে।
এদিকে রপ্তানি খাতে ডলারের সংস্থান থাকলেও পণ্যের আদেশ কমে যাওয়ায় এ খাতের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। গত অর্থবচরের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি কমেছে ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। এলসি কমেছে ১ শতাংশ। দুই অর্থবছর ধরে এ খাতে কাঁচামাল আমদানি কমছে। এর প্রভাবে রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি কমেছে ১১ শতাংশ, এলসি খোলা কমেছে ১৭ শতাংশ।
মৌলিক কাঁচমালের আমদানি ৩৪ শতাংশ ও এলসি কমেছে ১২ শতাংশ। শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি ৩৬ শতাংশ এবং এলসি কমেছে ১৭ শতাংশ। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতির এলসি ৬ শতাংশ এবং আমদানি ২৫ শতাংশ কমেছে।
প্রায় সব শিল্পের কাঁচামালের আমদানিই কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল। অথচ মোট শিল্প উৎপাদনের এ খাত থেকেই আসে প্রায় ৭২ শতাংশ। ফলে এ খাতের কাঁচামালের সরবরাহ কমায় সার্বিক শিল্প উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে রপ্তানিও কমছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বড় শিল্পের উৎপাদন বেড়েছে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগের দুই প্রান্তিকে বেড়েছিল যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ছোট, মাইক্রো ও মাঝারি শিল্পের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। আগের প্রান্তিকে বেড়েছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
কুটিরশিল্পের ৭ শতাংশ বেড়েছে। আগের প্রান্তিকে কমেছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। বড়, ছোট, মাঝারি ও মাইক্রো শিল্পের খাদ্যপণ্য উৎপাদন গত তিন প্রান্তিকেই কমেছে। কুটিরশিল্পের গত দুই প্রান্তিকে বেড়েছে। আগের প্রান্তিকে কমেছে। বড় উদ্যোক্তারা প্রণোদনা ও ব্যাংকিং সুবিধা পেলেও ছোটরা পাচ্ছে না। ফলে তারা পিছিয়ে পড়েছে। অনেকে খেলাপি হয়ে পড়েছে। ঋণ নবায়ন করতে পারছে না।
শিল্প খাত যখন পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় লিপ্ত, তখন বাড়ছে ঋণের সুদহার। আগে যেখানে ৮ থেকে ৯ শতাংশ ছিল, এখন তা বেড়ে ১২ থেকে ১৪ শতাংশে উঠেছে। ফলে এ খাতে খরচ বেড়েছে। কিন্তু পণ্য বিক্রিতে খরচ বাড়ার তুলনায় বাড়তি দাম পাচ্ছে না। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন সেবা দাম বাড়ানোর কারণেও খরচ বেড়েছে।