ইমরান কামাল: ‘নেশন’ শব্দটার সঙ্গে বর্তমানে আমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে আছি। অভ্যস্ততার মাত্রা এতটাই যে ‘নেশন’ অভিধাটির বিকল্প কিছু ভাবার তাড়নাও আমাদের মনে জাগে না। এর কারণ বোধ করি আধুনিক সভ্যতার ওপর যতটা ‘নেশন’ অভিধাটির প্রভাব, ততটাই এর অবিকল্প উপস্থিতি। তাই বর্তমানে খুব সহজেই নেশনকে মানুষকে সামষ্টিক পরিচয়ের ভাবকল্প আর ‘স্টেট’কে তার বস্তুগত প্রকাশ রূপে গ্রহণ করা যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক পৃথিবীতে ইতিহাসের উপনিবেশ পর্ব অতিক্রম করে আসার পর এই ‘গ্রহণ করা’র কাজটা এখন যত সহজ হয়ে গিয়েছে, খোদ উপনিবেশ পর্বে উপনিবিষ্ট বিদ্বৎ-সমাজের জন্য ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না।
উপনিবেশের কালে ‘নেশন’, ‘ন্যাশনালিটি’, ‘ন্যাশনালিজম’, ‘সামষ্টিক পরিচয়’-কথাগুলো নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে বিস্তর। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, সমাজতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক কারও পক্ষেই এই তর্ক এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এই বিতর্কে রবীন্দ্রনাথও শামিল হয়েছিলেন তাঁর মতো করে। ‘নেশন কী’ (১৩০৮ বঙ্গাব্দ) প্রবন্ধে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, নেশন ভাবের অধীনে আদৌ ভারতে রাষ্ট্র গঠন করা যাবে কি না। আর যদি গঠিত হয়, তাহলে সেই গঠন আদৌ আমাদের হবে কি। রবীন্দ্রনাথের এই রচনা তাঁর আত্মশক্তি বইয়ের প্রথম প্রবন্ধ হিসেবে গ্রন্থভুক্ত হয়েছিল। গ্রন্থরূপে আত্মশক্তির প্রকাশকালটিও বেশ চিত্তাকর্ষক-১৩১২ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৯০৫ সাল।
নেশন শব্দটি রবীন্দ্রনাথের মনে জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছিল কেন? তিনি নেশন শব্দটির বাংলা সমার্থকের সন্ধান করেছিলেন। খুঁজতে গিয়ে দেখেছিলেন, বাংলায় এর কোনো সমার্থক শব্দ নেই। এমনকি কাছাকাছি শব্দ দিয়েও নেশনের ভাবকে ধরা যাচ্ছে না। এ থেকে তাঁর বিকল্প সন্ধানের শুরু। রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করেছিলেন, ইউরোপে নেশন আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো অভিধা নয়। নেশন ইউরোপীয় সভ্যতার দীর্ঘ ঐতিহাসিক পরিক্রমার ফল। তাঁর এই বোঝাপড়ার মূল সূত্র ছিল এর্নেস্ত রেনাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা ‘হোয়াট ইজ নেশন?’ (১৮৮২)। রেনাঁর চিন্তাকে ব্যবচ্ছেদ করে রবীন্দ্রনাথ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, নেশন সৃষ্টির পক্ষে জাতি, ভাষা, বৈষয়িক স্বার্থ, ধর্মীয় ঐক্য অথবা ভৌগোলিক অবস্থান যথেষ্ট নয়। নেশন মূলত দুটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত এক সজীব সত্তা। তার একটি স্মৃতি, কীর্তি, মহত্ত্বে মিশেলে স্থিত অতীত। অন্যটি উত্তরাধিকার রক্ষার চেষ্টা, সমষ্টি হিসেবে টিকে থাকার সম্মতি, যৌথ কৌমরূপে বসবাসের ইচ্ছা (অথবা বাসনা) (পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘রাবীন্দ্রিক নেশন কী?’, প্রজা ও তন্ত্র, ২০০৮, অনুষ্টুপ, পৃ. ৭০)। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয় হয়েছিল, নেশন নিত্যবস্তু নয়, ইতিহাসের সৃষ্টি (পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘রাবীন্দ্রিক নেশন কী?’, পৃ. ৭০)।
ইতিহাসের সৃষ্টি বিধায় ইউরোপে নেশন গড়ে উঠেছে তার স্থান-কাল, পাত্র-মিত্র দ্বারা। সামষ্টিক ভাব ও পরিচয় অর্থে সেই গড়ে ওঠা ইউরোপে যেমন, ভারতের ক্ষেত্রে তেমন নয়। এই ধারণাই রবীন্দ্রনাথকে বিকল্প পথে চালিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক পরিক্রমা ইউরোপ থেকে ভিন্ন রকম। নেশন ভাবটি সেখানে অনুপস্থিত। তার বদলে যা আছে, সেটিকে তিনি আবিষ্কার করলেন সমাজরূপে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেছিলেন, নেশনের মূল কাজ ‘মানুষ বাঁধা’। ইউরোপ তার অতীত স্মৃতি ও বর্তমান বাসনার সমন্বয়ে মানুষ বাঁধার জন্য নেশন নামে একখানা ঘর বানিয়েছে। সে ঘর তার মতো করে তার ইতিহাসের যাত্রায়, ঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, ভারতকেও নিজের মানুষ বাঁধতে হলে তার মতো করে, তার স্মৃতি ও বাসনার সমন্বয়ে একখানা ঘর বানিয়ে নিতে হবে। অন্যের বানানো ভাবের ঘরে বসবাস করে গেলে যে শেষ পর্যন্ত আগন্তুক হয়ে থাকা হয়, ঘরখানা নিজের হয় না, আত্মও নিবাসে নির্বাসী থেকে যায় বোধ করি-এই ছিল রবীন্দ্রনাথের সংকট। রবীন্দ্রনাথ তাই ভারতের নিজস্ব এক ঘরের সন্ধান করেছিলেন। এমন ঘর যা ভারতের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। ভারতবাসীর কাছে যা হবে একান্তই আপন। রবীন্দ্রনাথ সেই মানুষ বাঁধার ঘরকেই সমাজ বলে মনে করেছিলেন। তিনি বোধ করেছিলেন হাজার বছর ধরে ভারতে জন-জীবন ও যাপনের সামষ্টিক অভিজ্ঞতায় সমাজই মানুষ বাঁধার উপযুক্ত আধার।
‘মানুষ বাঁধা’র কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ (১৩০৮) প্রবন্ধে। তিনি ভেবেছিলেন, নেশনের মূল কাজটি ভারতে সমাজ দিয়ে করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের এই যে মানুষ বাঁধা নিয়ে সংকট, তা মোটেও আকর্ষিকভাবে গজিয়ে ওঠা আপদ নয়। তৎকালীন উপনিবিষ্ট ভারতবর্ষে, বিশেষ করে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই জিজ্ঞাসা নানাজনের নানা কথার মধ্য দিয়ে বিবিধরূপে হাজির হয়েছিল। সেই বিচারে রবীন্দ্রনাথের এমত জিজ্ঞাসার পূর্বসূত্র বোধ করি ভূদেব মুখোপাধ্যায়। তিনিও কাছাকাছি স্বপ্নই দেখেছিলেন। তাঁর ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতের’ সজীব সত্তাটির সমাজ বলেই মনে হয়। যদিও ইতিহাসের সীমানায় দুজনের দেখাশোনায় ভেদ ছিল।
‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ-ও বলেন, ‘এই এক করিবার শক্তি ও কার্যকে ন্যাশনাল নাম দাও বা যে-কোনো নাম দাও, তাহাতে কিছু আসে যায় না, মানুষ-বাঁধা লইয়াই বিষয়’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’, আত্মশক্তি, রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৪২০, ৬২২)। অর্থাৎ সমস্যাটা নিত্য মানুষ বাঁধা নিয়ে নয়। উপনিবিষ্ট পৃথিবীতে এই ‘যায় না আসা’ তখনই সংকট হয়ে ওঠে, যখন তার সঙ্গে সামষ্টিক পরিচয়ের প্রসঙ্গটি যুক্ত হয়। জনসমষ্টির ঐক্যে পরিচয়ের প্রয়োজন। কোন পরিচয়ের অধীনে মানুষ এক হবে? উপনিবেশকের দেখিয়ে দেওয়া পথ ও পন্থাকে আত্মস্থ করে কি এই ঐক্য সম্ভব? সেই আত্মস্থ হওয়া পথ ও পন্থায় স্বকীয় পরিচয় কি বজায় রাখা যাবে? ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি সূত্রে প্রাপ্ত ‘নেশন’ দিয়ে উপনিবেশিত ভারতের মানুষকে বাঁধতে গেলে তা সম্পর্কের বন্ধন হবে, না কারাগার? মানুষ তো শুধু ঘর বাঁধে না, কারগারও গড়ে।
‘মানুষ বাঁধা’র কাজটির সঙ্গে আত্মপরিচয়ের প্রসঙ্গ নিবিড়ভাবে জড়িত। ফলে ‘নেশন’ দিয়ে মানুষকে বাঁধতে গেলে তা সম্পর্কের বন্ধন হবে, না সম্পর্কহীন বন্ধনের শিকল হবে, তা রবীন্দ্রনাথের জগতে চিন্তার বিষয় হয়ে উঠতে পেরেছিল। এই যে বলছি, চিন্তার বিষয় হয়ে উঠতে পারা-এটা বিষয় সম্পর্কে সচেতন হতে পারার সঙ্গে সম্পর্কিত। রবীন্দ্রনাথ বিষয় হিসেবে ‘মানুষ বাঁধা’ এবং সেই বাঁধার পথ ও পন্থা যেন নিজেদের মতো হয়, তা নিয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি চিন্তিত ছিলেন বন্ধন নাকি, শিকল হয়ে ওঠে-এই বিষয়ে।
রবীন্দ্রনাথের পরে দুনিয়ায় নেশনতত্ত্ব বহুদূর এগিয়েছে। ভাবের আধার রূপে নেশন, তার চালক-যন্ত্র রূপে রাষ্ট্র এখন আমাদের অবিকল্প আধার। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের কল্যাণে আমরা শিখেছি, নেশন এক এমন কল্পিত-কৌম (ইমাজিন্ড কমিউনিটি) যা হয়ে উঠেছে মুদ্রণ সংস্কৃতি আর পুঁজিবাদের যোগ বলে। নেশন কোনো ঊর্ধ্বস্থিত অটল সত্তা নয় সংবাদপত্র, কথাসাহিত্য, পাঠ্যপুস্তক, মানচিত্র, টাকা, সরকারি-বেসরকারি সহস্র রকম ছাপার অক্ষরের মধ্য দিয়ে এক বিরাট জনজীবন ‘ন্যাশনাল কনসাসনেস’ নামে প্রতিদিন নির্মিত হচ্ছে, মানুষের দৈনন্দিনের অংশ হচ্ছে, এটিকে নির্মাণ করছে, বেঁধে রাখছে (বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন, ইমাজিন্ড কমিউনিটি, ভার্সো, ২০০৬, পৃ. ৪৪-৪৫; পার্থ চট্টোপাধ্যায়, রাবীন্দ্রিক নেশন কী? পৃ. ৮৪)। নেশনের যন্ত্রকলা যাকে এককালে অন্তর্র্বতী ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়েছিল, খোয়াব দেখা হয়েছিল, একদিন রাষ্ট্র ভেঙে সমগ্র মানবজাতির অভিন্ন আধার, অভিন্ন পরিচয়, অভিন্ন চালক-যন্ত্র তৈরি হবে তা-ও আজ অসম্ভব দূরকল্পনা। যে অর্থে সে কল্পনা, তা এখন এতই দূর যে তার প্রয়োজনও নেহাত অপ্রয়োজনীয় বলে বোধ হয়।
‘মানুষ বাঁধা’র ঘর নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ কীভাবে সমষ্টিগত পরিচয়ের প্রশ্নে পাশ্চাত্য আধুনিকতার মধ্যে গড়ে ওঠা চিন্তাকে ব্যবচ্ছেদ করে দেশীয় অর্থ নির্মাণের কাজে লাগিয়েছিলেন। কীভাবে তাঁর আধুনিকতার ভেতরেই ছিল আধুনিকতাকে প্রত্যাখ্যানের ইচ্ছা (পার্থ চট্টোপাধ্যায়, রাবীন্দ্রিক নেশন প্রসঙ্গে আরও দু-চার কথা, প্রজা ও তন্ত্র, ২০০৮, অনুষ্টুপ, পৃ. ১২৪)।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ-ও দেখিয়েছেন যে এই অভিযাত্রায় রবীন্দ্রনাথ মোটেও একা ছিলেন না। উপনিবিষ্ট ভারতে যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে যেতে হয়েছিল, সেই সূত্রেই তাঁর নেশন ও রাষ্ট্র-সংক্রান্ত ধারণাগুলো গড়ে উঠেছিল এবং আমাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে।
মানুষ বাঁধার ঘর নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনার পাশাপাশি সেই আলোচনার বাইরে একটি সাধারণ কথা বর্তমান দুনিয়ায় প্রাসঙ্গিক মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ যে ঘর বাঁধার তাড়না অনুভব করেছিলেন, তার রূপ ব্যতিরেকে উদ্দেশ্যগত একটি আলাদা তাৎপর্য আছে। ঘরটি তিনি মানুষের জন্য বাঁধতে চেয়েছিলেন। এমনভাবে বাঁধতে চেয়েছিলেন যাতে মানুষ তার সক্রিয়, সজীব এবং প্রধান অনুষঙ্গ হয়। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের ঘর আছে, কিন্তু ঘর মানুষের হতে হলে যে প্রয়োজনীয় শর্তটি দরকার, তা-ই যেন হারিয়েছে। মানুষ বড্ড গৌণ হয়ে আছে। উন্নয়ন, বিকাশ, ঊর্ধ্ব গগনে যাত্রা-সবই চলছে, মানুষের জন্য চলছে, মানুষের নামেই চলছে। কিন্তু কোথাও যেন সে নেই।
কেবল সাধারণ বিশেষ্যরূপে তার হাজিরা আছে। সক্রিয়, সজীব উপস্থিতি!- খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গুজব আছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকি সন্নিকটে। রবীন্দ্রনাথ একটি বিশ্বযুদ্ধের আদ্যোপান্ত সাক্ষী ছিলেন, আরেকটির সূত্রপাত দেখেছিলেন। মানুষের সংখ্যা বনে যাওয়া তিনি নিজ চোখেই দেখে যেতে পেরেছিলেন। তৃতীয়টি ঘটলে তার সাক্ষী হব আমরা এবং সেই অবস্থার ব্যতিক্রম অন্তত হবে না। ইতিমধ্যে বিপর্যস্ত প্রকৃতি আরও বিপর্যস্ত হবে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষ বেঁচে থেকে সংখ্যা হয়ে আছে। আধুনিক রাষ্ট্রসংঘাতে কাতারে কাতারে মরতে মরতেও সে সংখ্যাই হয়ে থাকবে হয়তো এই (অ) গতি আরও বেগবান হবে। যে ঘর মানুষের নামে বাঁধা হয়েছে, সে ঘরে মানুষের অনুপস্থিতিসুলভ উপস্থিতির, তার প্রেতসুলভ অস্তিত্বের দুনিয়াতে এক সজীব, সক্রিয় মানুষের স্বপ্নকে অন্তত রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা ধার করে আনতেই পারি। তাঁর কাছ থেকে শিখে নিতে পারি যে ঘর মানুষের জন্যই বাঁধতে হয়, অন্য উদ্দেশ্যে নয়।