ডাক্তার রশীদের ‘আমাদের বাড়ি’

ডাক্তার রশীদের ‘আমাদের বাড়ি’

বার্তা ডেস্ক: শিশু ও বয়স্কদের জন্য অনন্য এক প্রতিষ্ঠান। নিজের বাড়িতে বসবাসের ধ্যান-ধারণা নিয়ে যেমন সকলেই জীবন কাটিয়ে দেয়। ঠিক তেমনিভাবে যারা অসচ্ছল, গরিব বা সচ্ছল হলেও যাদের দেখাশোনার কেউ নেই, তাদেরই শুধু ‘আমাদের বাড়িতে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ডা. এম এ রশীদের এই উদ্যোগের ভবিষ্যৎ উপযোগিতাকে সমর্থন দিচ্ছে সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যও। দেশের মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগ এখনো তরুণ। কিন্তু ৬০ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ যথাযথ যতœ নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে সংকট তৈরি হতে পারে।
‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন। যা মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্য বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সিদের সংখ্যা হবে ৩.৬ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রতি ছয় জনের মধ্যে এক জনের বয়স হবে ৬০ বছর বা তার বেশি ।
এদিকে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সংখ্যায় বাড়তে থাকা এই প্রবীণ নাগরিকদের যতœ ও সহায়তার জন্য দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান সুবিধাগুলো একেবারেই যথেষ্ট না । আর মাত্র এক দশকের মধ্যেই দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির যে তথ্য মিলেছে, তাতে ডা. রশীদের ‘আমাদের বাড়ি’ যে ভবিষ্যতে অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠবে এতে সন্দেহ নেই। কেননা, শিশু ও বয়স্কদের সেই সুবিধাগুলোকে মাথায় রেখেই গড়ে তোলা হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। ‘আমাদের বাড়ি’র স্বপ্নদ্রষ্টা জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. এম এ রশীদ বলেন, এসব চিন্তা থেকেই এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ।
সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারের ছেলে- মেয়েরা দেশে-বিদেশে কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছে। বাড়িতে থেকে যাচ্ছেন প্রবীণরা। তারা হয়ে পড়ছেন অবহেলিত। তাদের দেখার কেউ থাকছে না। আবার বাড়ি থেকে মা-বাবা কাজে চলে গেলেও বাড়িতে দাদা- দাদি, নানা-নানির কাছে রয়ে যাচ্ছে নাতি-নাতনিরা। ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরও দেখভালের কেউ থাকছে না। এজন্য দাদা-দাদি, নানা-নানি, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে এখানে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। অপরদিকে, সমাজের আরেকটি বড় অংশ অবহেলিত শিশুরা। এদের আমরা অনাথ বা এতিম বলছি না। যথাযথ সুবিধার অভাবে এরা মাদকাসক্তসহ নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে । এসব শিশুদেরও এখানে নিয়ে এসে যতেœর সঙ্গে গড়ে তোলা হচ্ছে, যেন তারা বিপথগামী হতে না পারে ।
ডা. রশীদ জানান, এখানে বিনা মূল্যে, আবার কেউ চাইলে খরচ দিয়ে থাকতে পারবেন। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠান । ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের অনুদানে এর ব্যয় মেটানো হয় । যে কেউ চাইলে এখানে আর্থিক সহায়তা দিয়ে সামাজিক অবদান রাখার সুযোগ পাবেন। এখানে দেওয়া সহায়তার অর্থ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত সুবিধার আওতায় রয়েছে। সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রফেসর ডা. এম এ রশীদ।
যশোর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার নাটুয়াপাড়া গ্রামে গড়ে উঠেছে ‘আমাদের বাড়ি” । যশোরের সন্তান ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ডা. এম এ রশীদ ‘আমাদের বাড়ির স্বপ্নদ্রষ্টা। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই প্রবীণ ও শিশু নিবাস ‘আমাদের বাড়ি’। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ‘গফুর মরিয়ম সাত্তার সাকেরা ফাউন্ডেশনের (জিএমএসএস) যৌথ উদ্যোগে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হয়েছে ।
এর ৮০ শতাংশ সরকারের এবং ২০ শতাংশ জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের । গ্রামীণ মনোরম পরিবেশে প্রায় দুই একর জমির ওপর এটি নির্মিত। চারতলাবিশিষ্ট ভবনটিতে ১২০ জন বসবাস করতে পারবেন । বর্তমানে আট জন মহিলা, ছয় জন পুরুষ এবং ১২ জন শিশুর বাড়ি এটি। এই ২৬ জনের দেখভালের জন্য রয়েছেন ১৮ জন লোক। তবে, এ ফাউন্ডেশন ১৯৮১ সাল থেকেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছে। গ্রামের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ ১৯৮১ সালে আব্দুল গফুর মেমোরিয়াল মাধ্যামিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ১.৬০ একর জমিতে ১৯ জন শিক্ষক নিয়ে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। রয়েছে মরিয়ম বিবি মহিলা দাখিল মাদ্রাসা। কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটির প্রাথমিক অনুদানে মাদ্রাসায় একতলাবিশিষ্ট ১১টি রুমের প্রথম ভবন তৈরি করা হয়। বর্তমানে মাদ্রাসাটিতে ১৮ জন শিক্ষক ও প্রায় ৩৫০ শিক্ষার্থী পড়ছে ।
এর পাশাপাশি ফাউন্ডেশন শিক্ষাবৃত্তি প্রকল্প চালু করেছে, যা অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করছে। এই কার্যক্রমের ব্যয়ভার মূলত জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের নিজস্ব অর্থায়ন ও বিভিন্ন ব্যক্তি-অনুদান দ্বারা নির্বাহ করা হয়। ‘আমাদের বাড়ি’র ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে প্রফেসর রশীদ বলেন, এখানে শিশু ও বয়স্করা শুধু থাকবে, খাবে আর ঘুমাবে—ব্যাপারটা এমনও না। এই কম্পাউন্ডের চারপাশ জুড়ে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল, মহিলা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে তারা লেখাপড়া শিখতে পারবে । প্রবীণদের জন্য এখানে ব্যবস্থা আছে কৃষিকাজ, বাগান করা, পোলট্রি, গরু-ছাগলের খামার, মাছচাষের মতো কাজে যুক্ত থাকার সুযোগ।
রয়েছে শরীরচর্চা, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার সবরকম সুবিধা। এমনকি ইসিজি, এক্সরেসহ প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, বার্ষিক স্বাস্থ্য চেকআপ, জরুরি প্রয়োজনে নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে শহরের দুটি হাসপাতালের সঙ্গে করা চুক্তির আলোকে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসুবিধার ব্যবস্থা। ছোট-বড় সবার জন্যই রয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ।
‘আমাদের বাড়ি’র সদস্যদের জীবন এখন যেমন: জীবন সম্পর্কে কিছুই বুঝে ওঠার সময় হয়নি ছয় বছরের ছোট্ট শিশু মুস্তাকীনের। কিন্তু ছয় বছরেই জীবন তার বড় পরীক্ষাই নিয়েছে। মুত্তাকীনের মাকে ছেড়ে চলে গেছে তার বাবা। আর মা আবার বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে। নানির কাছে ঠাঁই হলেও বাসাবাড়িতে কাজ করে নানি তাকে টানতে পারছিল না। তাই শিশুটির নতুন ঠিকানা ‘আমাদের বাড়ি’। মুত্তাকীন বলে, নানি অন্যের বাসায় কাজ করে খায়। আমাকে খাওয়াতে পারে না। তাই এখানে রেখে গেছে।
৯ বছরের মো. লিসান হোসেনের জীবনের গল্পটা উলটো। মা ছেড়ে গেছে তার নাইটগার্ড বাবাকে। দাদি তাকে রেখে গেছে এই ঠিকানায় ।
বয়সিদের জীবনের গল্পগুলোও ভিন্ন ভিন্ন বাঁক বদলের । ঢাকার টিপু সুলতান রোডের ষাটোর্ধ্ব ইয়াসমীন বেগম শিল্পীর দুই ছেলেই বিদেশে থাকে । ছেলের বউয়ের কাছে না রেখে ছেলে তাকে রেখে গেছে এখানে ।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার নন্দলালপুর গ্রামের সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘দেড় বছর এখানে আছি ।
বাড়ির মতোই থাকি । সকালে ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হই । এরপর গোসল করে নাস্তা খাই । এখানে সবাই মিলে খেলাধুলা করি । আমরা সবাই এক হয়ে গেছি ।” আমাদের বাড়ি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আতিয়ার রহমান বাচ্চু বলেন, আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে আমাদের বাড়ি প্রকল্পে। এখানে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত ৬ থেকে ১৮ বছরের শিশু এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে প্রবীণরা পারিবারিক বন্ধনের ছায়ায় বসবাস করছে। তাদের জন্য বিনা মূল্যে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, বস্ত্র, শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে ।
প্রকল্পের নিজস্ব খামারে উৎপাদিত শাকসবজি, মাছ, মাংস খাবার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে, যাতে খাবারের গুণমান ও পুষ্টি নিশ্চিত হয় । এখানে শরীরচর্চার জন্য ব্যায়ামাগার ছাড়াও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে পারছেন ‘আমাদের বাড়ির বাসিন্দারা।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *