খন্দকার রেজাউল করিম: মিশরের রানি ক্লিয়োপেট্রা মিশরীয় ছিলেন না, তার পূর্বপুরুষ এসেছিল গ্রিসের মাইসেনিয়া থেকে। মাইসেনিয়ার রূপসী রানি হেলেনকে নিয়ে ট্রয় নগরীতে যে যুদ্ধ বেধেছিল তার গল্প মহাকবি হোমারের ইলিয়াড এবং অডেসি মহাকাব্যে লেখা আছে। উপকথার হেলেন থেকে রক্তমাংসের হেলেনকে আলাদা করা কঠিন, তিনি কতখানি সুন্দরী ছিলেন তা জানার কোনো উপায় নেই। প্রাচীন আমলে রাজা-রানিরা দেবতাদের বংশধর বলে দাবি করতেন। এতে রাজা এবং প্রজা দুই পক্ষেরই লাভ। রাজা দেবতার বংশধর হলে দেবতাদের দেওয়া ভূমিকম্প, বন্যা, প্লাবন, মহামারির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে! তেমনি কোনো প্রজা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে ভয় পাবে, রাজকার্য সহজ হয়ে যাবে। জুলিয়াস সিজারকে দেবী ভেনাসের এবং ক্লিয়োপেট্রাকে সৌন্দর্যের দেবী আইসিস এবং এফ্রোডাইটির বংশধর হিসাবে ধরা হতো। আলেক্সান্ড্রিয়ার আইসিস দেবীর মন্দিরে ক্লিয়োপেট্রার একটি সোনার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। সোনার মূর্তি গড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবুও চোরডাকাতের হাত এড়িয়ে এ মূর্তিটি কয়েকশ বছর টিকে ছিল। তাছাড়া ক্লিয়োপেট্রার ছবি সেই আমলের মিশরের মুদ্রায় আঁকা আছে, তা থেকে তার মুখ, কান, নাকের গঠন এবং চুলের পরিমাণ অনুমান করা যায়। উঁচু নাক, বিস্তৃত চিবুক ছিল তার চেহারার অনন্য বৈশিষ্ট্য। ক্লিয়োপেট্রার চেহারা পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ফরাসি দার্শনিক প্যাসকেল লিখেছিলেন, ‘যদি ক্লিয়োপেট্রার নাক আরেকটু ছোট হতো তাহলে পৃথিবীর চেহারা আজ অন্য রকম হতো।’
ক্লিয়োপেট্রা জন্মেছিলেন মিশরের আলেক্সান্ড্রিয়া শহরে। এ শহরে জন্মেছিলেন হাইপেশিয়া নামে আরেক রূপসী মহিলা, যিনি জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, দর্শনে সেই যুগে সবার সেরা ছিলেন। হাইপেশিয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমির সৌরজগৎ মডেলের কিছু গরমিল বের করেছিলেন। গ্যালিলিও, সক্রেটিস, আর্কিমিডিসের নাম সবাই জানে, কিন্তু হাইপেশিয়ার কথা কয়জন শুনেছেন? ক্লিয়োপেট্রা যে সুন্দরী ছিলেন, তাও সবাই জানে, কিন্তু তিনি যে আটটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন তা হয়তো অনেকেরই অজানা। সেআমলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাঠাগার ছিল আলেক্সান্ড্রিয়ায়। এ লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে একদল বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, দার্শনিক, কবি, জ্ঞানপিপাসু এবং মুক্তমনা জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাইপেশিয়া ছিলেন এ গোষ্ঠীর একজন সক্রিয় সদস্য। হাইপেশিয়া ইহুদি এবং খ্রিষ্ট ধর্মে বিশেষজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু কোনো ধর্মের ওপরে তার বিশেষ কোনো অনুরাগ ছিল না। রূপসী হাইপেশিয়ার পানিপ্রার্থীর অভাব ছিল না, কিন্তু তিনি কাউকে পাত্তা দিতেন না। যে মেয়ে টলেমির মডেলে ভুল ধরে, তাকে পটানো সহজ নয়! এক নাছোড়বান্দা সুদর্শন প্রেমিককে অনিন্দসুন্দরী হাইপেশিয়া বলেছিলেন, ‘তুমি সুন্দরের পূজারি নয়, তুমি কী চাও তা আমি জানি।’ মেয়েদের এত গরব থাকা কী ভালো? এমন মেয়েকে আলেক্সান্ড্রিয়ার পাদ্রি এবং পুরুষ মোড়লরা সহ্য করে কী করে? ওই সময় খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের মধ্যে একটা দাঙ্গা বাধে এবং সেই সুযোগে পাদ্রির প্ররোচনায় খ্রিষ্টান ধর্মজঙ্গিরা হাইপেশিয়াকে পাথর ছুড়ে খুন করে; পরে তার হাত, পা, মাথা, ছিন্ন করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
আলেক্সান্ড্রিয়া লাইব্রেরির প্রভাব ক্লিয়োপেট্রার ওপরেও পড়েছিল। রোমান বীর জুলিয়াস সিজার ক্লিয়োপেট্রার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়েছিলেন ঠিকই, তবে পরে আরও অভিভূত হয়েছিলেন ক্লিয়োপেট্রার শিক্ষা এবং জ্ঞানে। রোমে তখন জ্ঞানচর্চার চেয়ে যুদ্ধচর্চা বেশি হতো। আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরির মতো একটি লাইব্রেরি জুলিয়াস সিজার রোমে বানাতে চেয়েছিলেন। রূপসী মেয়ের সব গুণ রূপের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। কোনো রূপসী মেয়ে কবি বা বিজ্ঞানী হলে সবাই তার রূপের কথাটাই মনে রাখে, তার অবদানের কথা ভুলে যায়। কেন? কারণ, আজ পর্যন্ত সব ইতিহাস পুরুষদের লেখা। মোগল সাম্রাজ্যের আরেক রূপসী নারী লিখেছিলেন,
‘গরিব-গোরে দীপ জ্বেলো না, ফুল দিও না কেউ ভুলে।
শামাপোকার না পোড়ে পাখ্ দাগা না পায় বুলবুলে।’
(কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ)
লড়াই করতে যেয়ে জীবনে বই পড়ার সুযোগ জুলিয়াস সিজার তেমন একটা পাননি। তার আদর্শ পুরুষ আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট অ্যারিস্টটলের ছাত্র ছিলেন। এমন সুযোগ সিজারের জীবনে আসেনি। এ ক্ষোভ তিনি পূর্ণ করেছিলেন মেয়ে জুলিয়ার মধ্যে দিয়ে। এক বৃদ্ধ গ্রিক ক্রীতদাসের জ্ঞানের পরিমাণ দেখে মুগ্ধ জুলিয়াস সিজার তাকে নিজের মেয়ের সার্বক্ষণিক শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন। এ বুড়ো শিক্ষক এবং কিশোরী শিক্ষার্থী জুলিয়া অনেক দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করত। জুলিয়াস সিজার মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়ে তা শুনতেন। রোমের এক ক্রীতদাস বিদ্রোহের সময় এ শিক্ষকের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রোমের প্রথামতো আরও অনেক ক্রীতদাসের সঙ্গে শিকল পরা অবস্থায় এ শিক্ষককে সৈন্যরা প্যারেড করে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছিল। মিছিলের সামনে ছিল রোমান সেনাপতি পম্পি। জুলিয়া ছুটে গিয়ে পম্পির পায়ে ধরে তার শিক্ষকের প্রাণভিক্ষা চায়। পম্পি শিক্ষককে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু শিক্ষক রাজি হননি। তিনি জুলিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘মনে আছে, তোমাকে কী শিখিয়েছিলাম? বিপদের দিনে সাথিদের ছেড়ে পালানোর মতো কাপুরুষতা আর কিছুতেই নেই। আমার এমন অসম্মান তুমি হতে দিয়ো না, আমাকে আমার বন্ধুদের সঙ্গে মরতে দাও, তোমার কাছে এটাই আমার শেষ চাওয়া।’ জুলিয়ার শিক্ষক সহ-বিদ্রোহীদের সঙ্গে ক্রুশকাঠে বিদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পরে এ পম্পির সঙ্গেই জুলিয়ার প্রেম এবং বিয়ে হয়েছিল।
রাজত্বের ভাগাভাগি নিয়ে রাজপুত্রদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। প্রথম অটোম্যান সাম্রাজ্যে সুলতানের মৃত্যুর পরে সব রাজকুমারদের মধ্যে প্রাণঘাতী যুদ্ধ শুরু হতো, যে বেঁচে থাকবে সেই হবে নতুন সুলতান। অনেক সময় সুলতানের অনেক শিশুপুত্র থাকত। শিশুরা যুদ্ধ করবে কী করে? তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। সুলতান নির্বাচনের এ বর্বর পদ্ধতি (ভৎধঃৎরপরফব) বাতিল করে দ্বিতীয় অটোম্যান সাম্রাজ্যে সুলতানের প্রথম পুত্রের হাতে রাজত্বের ভার দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। অনেক সময় রাজার জামাইরাও এ রাজ্য ভাগাভাগির যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত, খুনোখুনি আরও বেড়ে যেত। এ ঝামেলা থেকে বাঁচা যায় কী করে? মোগল সাম্রাজ্যে রাজকন্যাদের বিয়েই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শাহ জাহানের মেয়ে জাহানারা বেগম, আওরঙ্গজেবের মেয়ে জেবুন নিসা, রূপসী এবং বিদুষী কবি ছিলেন, কেউ বিয়ে করেননি। রাজপুত্র এবং রাজ-জামাতার মাঝের দ্ব›দ্ব থেকে রেহাই পাওয়ার আরেকটা উপায় আছে। যদি ভাইবোনের বিয়ে হয়! মিশরের রাজপরিবারে এ রীতি প্রচলিত ছিল, রাজার ছেলেকে নিজের বোনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হতো। ক্লিয়োপেট্রা ১৭ বছর বয়সে তার ১৩ বছরে ছোট ভাই টলেমিকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। জেনে রাখা ভালো, যে কেউ বিখ্যাত হলে তার নাম অন্যজনরা বারেবারে গ্রহণ করে; সেই যুগে অসংখ্য সিজার, ক্লিয়োপেট্রা এবং টলেমি ছিল। এখানে আমরা ৭ নম্বর ক্লিয়োপেট্রা এবং ১৩ নম্বর টলেমির কথা বলছি।
বাংলাদেশে যাত্রাগানের ১২ বছরের রূপসী রূপবান কন্যা ১২ দিনের শিশুর সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব শুনে বেজায় মুষড়ে পড়ে গান ধরেছিলেন,
‘ভ্রমর বিনে ফুলের মধু গো, ও দাইমা যাবে কি শুকাইয়া গো,
আমার দাইমা, দাইমা গো।
আমার যৌবন বৃথা যাবে গো, এ কী বিধির লিখন গো,
আমার দাইমা, দাইমা গো।’
যৌবনের আগুন আঁচলচাপা দিয়ে রূপবান কন্যা তার শিশু স্বামীকে লালনপালন করেছিলেন। বিধির বিধান নীরবে মেনে নিয়ে যাত্রাগানের রূপবান হয়তো সুখেই ছিলেন। রক্ত মাংসে গড়া লাস্যময়ী ক্লিয়োপেট্রার কাছে এমন মনোভাব আশা করা উচিত হবে না। অল্পবয়স্ক ভাইকে বিয়ে করে তিনি সুখী হননি।