বাণিজ্য ডেস্ক: দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকরা এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। এমন তথ্য জানিয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা বলেছেন- বহুমুখী চাপে আছেন পোশাকশিল্প মালিকরা। এখন পোশাকশিল্প খাতের অবস্থা খারাপ। বর্ধিত নতুন ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের চাপ মালিকদের ওপর। আবার ক্রেতাদের চাপ নতুন ক্রয়াদেশ দাম না বাড়ানোর। সুদহার বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির চাপ তো আছেই। পাশাপাশি শ্রমনীতি ও অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি নিয়ে আরও সচেতন হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সভাপতি ফারক হাসান বলেন, বর্ধিত নতুন ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন নিয়ে চাপে আছি। বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর চাপ। আবার ক্রেতারা দাম না বাড়ানোর চাপ দিচ্ছে। আমাদের মালিকরাও নতুন ক্রয়াদেশে পোশাক পণ্যের দাম বাড়ানোর চাপ দিচ্ছেন। এমন বহুমুখী চাপের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন পোশাকশিল্প মালিকরা।
বৈশ্বিক বাজার নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা তুলে ধরে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত ৯ মাসে প্রায় ৩০ শতাংশ রপ্তানি কম হয়েছে। আবার জিএসপির আলোকে বাজার সুবিধা ধরে রাখতে শ্রমনীতি সংস্কার করতে বলছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত ১০ বছরে দেশে শ্রম আইনের অনেক বেশি সংস্কার হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের শ্রমনীতি ও জিএসপি সুবিধা নিয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকশিল্প মালিকরা কোনো সুবিধা পান না।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম বলেন, আমাদের পোশাকশিল্প খাতের অবস্থা খারাপ। এ খাতে বহুমুখী সংকট চলছে। ব্যাংকিং খাতে সমস্যার শেষ নেই। কাস্টমস নিয়ে প্রতিদিন অভিযোগ পাচ্ছি। ঋণপত্র বা এলসির অর্থ পরিশোধে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। এসব সমস্যার কারণে চলতি ডিসেম্বর থেকে বর্ধিত মজুরি কাঠামো কার্যকর করা অসম্ভব।
আমাদের অধিকাংশ কারখানায় ক্রয়াদেশ নেই। বাংলাদেশের শ্রমনীতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। আমাদের শ্রমমান অনেক দেশের তুলনায় ভালো বলে মনে করেন এ বিকেএমইএ নেতা।
সর্বশেষ ২১ নভেম্বর জিএসপি কর্মসূচির ওপর মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় কমিশন। প্রতিবেদনে ইউরোপীয় কমিশন বলেছে, বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি বিষয়ে মূল উদ্বেগগুলো হচ্ছে- ট্র্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন, ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং অবাধে ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম চালানোর অধিকারের আইনি বাধা; ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য ন্যূনতম সদস্যের প্রয়োজনীয়তা এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতি।
মূল্যায়নে এসব বাধা দূর করার তাগিদ দেওয়া হয়। পাশাপাশি কারখানা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার ঘাটতি সমাধানের কথা বলা হয়েছে। সহিংসতা, হয়রানি, বরখাস্ত, অপর্যাপ্ত তদন্ত, মামলা ও কর্মীদের গ্রেফতারের মতো ইউনিয়নবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া শ্রম পরিদর্শনে সক্ষমতা ও সামর্থ্যরে ঘাটতি দূর করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শিশু ও জোরপূর্বক শ্রমের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ইপিজেড শ্রমবিধি এবং শ্রম আইন ও ইপিজেড শ্রম আইনের উপবিধি সংশোধন হলেও আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডে পৌঁছাতে এখনো ঘাটতি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে জিএসপি সুবিধা পাওয়া তিন দেশ বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে ইইউ। কারণ হিসেবে ইইউ বলছে, দেশগুলোতে মৌলিক মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের মানদণ্ডের প্রতি সম্মান দেখানোর ঘাটতির বিষয়টি জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও সুশীল সমাজের প্রতিবেদনে প্রমাণিত। ইইউ বলেছে, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে ব্যর্থ হলে সুবিধাভোগী দেশগুলো তাদের জিএসপি সুবিধা হারাতে পারে। এর আগে বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে পোশাকশিল্প মালিকদের।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্মারকে (প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডাম) সই করেছেন।
অংশীজনরা বলছেন, শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ঘোষণা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে অস্থিরতা চলছে। শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির বিষয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হলো, এ দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। পোশাক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মৎস্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্যসহ নানা ধরনের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবির তথ্য বলছে- ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৯৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যার মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৫১ কোটি ডলার।