মুহাম্মদ জহিরুল আলম
সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় মহান আল্লাহ্ তাঁর সমস্ত রূপ ও গুণের ধারক রূপে সর্বপ্রথম ‘নুরে মোহাম্মদী’ সৃষ্টি করেন। আর এই ‘নুরে মোহাম্মদী’ হতে সমস্ত বিশ্বজগৎ সৃজিত হয়েছে। মহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাহ্র নিকট থেকে এক নুর ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ১৫) আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “মহিমান্বিত আল্লাহ্ সর্বপ্রথম আমার নুর সৃষ্টি করেছেন।” (তাফসীরে রূহুল বয়ান ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭০) মহান আল্লাহ্ অন্যত্র এরশাদ করেন, “হে রাসুল (সা.)! আমি তো আপনাকে জগতসমূহের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।” (সূরা আল আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭) সৃষ্টির শুরু থেকেই মহান আল্লাহ্ প্রতিটি জতির জন্য নবি-রাসুল প্রেরণ করেছিলেন, দয়াল রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.) একমাত্র রাসুল যিনি সমস্ত সৃষ্টির রহমতস্বরূপ জগতে তাশরিফ নিয়েছিলেন। তিনি হলেন সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত, কল্যাণ ও হেদায়েতের মূল। মহান আল্লাহ্ সমগ্র নবি-রাসুলের আত্মা সৃষ্টির পর, হযরত রাসুল (সা.)-কে সামনে এনে জিজ্ঞাসা করলেন- তোমরা তোমাদের কওমকে বলবে হযরত রাসুল (সা.) আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু, তিনি জগতে তাশরিফ আনবেন। তাঁরা তখন সাক্ষী দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ্র কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, তাঁরা তাঁদের জাতির কাছে তাঁর কথা বর্ণনা করবেন।
দয়াময় আল্লাহ্ তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি হযরত রাসুল (সা.)-কে হিজরিপূর্ব ৫৩ সালের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদেকের সময় এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। এ দিনটি আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। হযরত রাসুল (সা.)-কে প্রেরণের আনন্দের আতিশয্যে মহান আল্লাহ্ ফেরেশতাদের নিয়ে তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করেন এবং মানুষকেও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করে শ্রদ্ধার সাথে সালাম জানাতে নির্দেশ করেছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ নিজে ও তাঁর ফেরেশতারা নবির উপর দরুদ পাঠ করেন। হে বিশ্বাসীরা! তোমরাও তাঁর উপর দরুদ পাঠ করো এবং শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো।” (সূরা আল আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬) অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, “হে রাসুল (সা.)! আমি আপনার জিকির বা স্মরণকে সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছি।” (সূরা আল ইনশিরাহ ৯৪: আয়াত ৪)
আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ বন্ধুর জন্মদিন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। তাঁর শুভ জন্ম লগ্নে হেরেম শরীফ আনন্দে কম্পিত হয়ে ওঠে এবং কাবা ঘরের ‘হুবুল’ নামক বৃহৎ মূর্তিটি উপুর হয়ে পড়ে যায়। নওশেরাওয়া বাদশাহর সিংহাসন নড়ে ওঠে। মাওয়া দরিয়া শুকিয়ে যায় ও পারস্যের অগ্নিকুণ্ড হঠাৎ নিভে যায়। ঐ রাতে কোরাইশদের একটি মূর্তির মুখ দিয়ে কথা বের হয়েছিল। সে বলেছিল, একটি পবিত্র সন্তানের শুভাগমনে চাদর পরিধান করেছি। এর জ্যোতিতে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমের সমস্ত এলাকা আলোকিত হয়ে গিয়েছে।
মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্Ÿুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান আল্লাহ্র প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-কে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ ঈদ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ‘ঈদ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে খুশি, আর ‘মিলাদুন্নবি (সা.)’ শব্দের অর্থ হচ্ছে হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্ম। ফলে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর অর্থ দাঁড়ায় হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের খুশি। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান বলেন, “রহমত, বরকত, মাগফেরাত বা ক্ষমা লাভের উত্তম সুযোগ ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদ্যাপন করা। আর এটি এমন একটি অনুষ্ঠান, যেটি রাসুল (সা.)-এর জন্মের অনুষ্ঠান। আপনি যদি খুশি হন তাহলে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন খুশি হবেন। যার ফলে আপনি যদি আল্লাহ্র দরবারে ক্ষমা চান রাব্বুল আলামিন আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন।”
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, “(হে হাবিব) আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩১) অর্থাৎ দয়াল রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসাই দয়াময় আল্লাহ্কে ভালোবাসা। দয়াল রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার মাধ্যমেই রহমত বরকত লাভ হয়। দয়াল রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদ্যাপন, হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তাঁর বিখ্যত ফতহুল বারী কিতাবে উল্লেখ করেছেন, হযরত সুহাইলি (রা.) কর্তৃক হযরত আব্বাস (রা.) থেকে এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, “আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্নে দেখি যে, সে অত্যন্ত আজাবের মধ্যে আছে। আবু লাহাব তার অবস্থা সম্পর্কে জানায়, ‘তোমাদের ছেড়ে আসার পর থেকে আমি শান্তির মুখ দেখিনি, তবে প্রতি সোমবার আমার আজাব লাঘব করা হয়।’ হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তার আজাব লাঘবের কারণ হলো- হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর শুভ জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুয়াইবাকে সে খুশি হয়ে মুক্তি দিয়েছিল’।” (ফতহুল বারী, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৮) এ প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “একজন কাফির হয়েও হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের সংবাদে খুশি হওয়ায় যদি আবু লাহাব উপকৃত হতে পারে, তাহলে হযরত রাসুল (সা.)-এর উম্মত হয়ে তাঁর শুভ জন্মদিন আনন্দের সাথে উদ্যাপন করে নিঃসন্দেহে আমরা উপকৃত হবো। আমরা যদি এ যুগে তাঁর শুভ জন্মদিন মহাধুমধামের সাথে পালন করি, তাহলে দয়াল রাসুল (সা.) আমাদের উপর খুশি হবেন। ফলে আমাদের মুক্তির পথ খুলে যাবে।” (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২৯)
দয়াল রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন আশেকে রাসুলগণ যাতে উদ্যাপন করতে না পারে সেজন্য এজিদের শাসনকাল থেকেই চক্রান্ত করে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত একই দিবসে বলে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে মুসলমানদের মাঝে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান এই ভুল সংশোধন করে মুসলমান জাতিকে সঠিক তথ্য প্রদান করেন। সূফী সম্রাট বলেন, হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্ম ১২ই রবিউল আউয়াল, ৬৩ বছর পর তাঁর ওফাত হয়েছে ১লা রবিউল আউয়াল। তিনি হিসেব করে দেখিয়েছেন, ১০ম হিজরির ৯ই জিলহজ শুক্রবার বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয়। এর ৮০ দিন পর অর্থাৎ ৮১তম দিবসে হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত হয়। সেই হিসেবে ১লা রবিউল আউয়ালই হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত দিবস। অপরদিকে আখেরি চাহার শোম্বা হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের ৫ দিন পূর্বে হয়েছে। অর্থাৎ হযরত রাসুল (সা.) ১১শ হিজরির সফর মাসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সফর মাসের শেষ বুধবার (২৫শে সফর) আবার সুস্থ হন। যাকে আখেরি চাহার শোম্বা বলা হয়। এর ৫ দিন পর হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত লাভ হয়, তিনি ঐ বুধবারের পর আর কোনো বুধবার পাননি। অর্থাৎ সোমবার তিনি ওফাত লাভ করেছেন। হিসেব অনুযায়ী এ দিনটি ১লা রবিউল আউয়ালই হয়। হযরত রাসুল (সা.) ১লা রবিউল আউয়াল সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পূর্বে ওফাত লাভ করেন। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে পড়তে সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। চন্দ্রমাসের তারিখ সূর্যাস্তের পর থেকে গণনা করা হয় বিধায় কেউ কেউ বলেছেন তিনি ২রা রবিউল আউয়াল ওফাত লাভ করেছেন। ফলে হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের তারিখটি ১ অথবা ২ রবিউল আউয়াল হিসেবে প্রচারিত হয়। এ সুযোগেই উমাইয়া শাসকেরা চক্রান্ত করে হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের তারিখ ১ ও ২-কে একত্রিত করে ১২ই রবিউল আউয়াল হিসেবে প্রচার করেছে। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান এ চক্রান্ত থেকে আমাদের রক্ষা করেন এবং ১২ই রবিউল আউয়াল দয়াল রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের আনন্দে আনন্দিত হয়ে দিনটি উদ্যাপনের আহবান জানান।
১২ই রবিউল আউয়াল হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিন এবং ১লা রবিউল আউয়াল তাঁর ওফাত দিবস। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর অশেষ বরকতময় শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর গুরুত্ব তুলে ধরে একে সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালনের প্রস্তাব করেন। পরবর্তীতে ১২ই রবিউল আউয়াল ফাতেহায়ে দোয়াজদাহম ও সিরাতুন্নবি (সা.)-এর পরিবর্তে, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং দিনটি পালনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
যারা আল্লাহ্র হাবিবকে ভালোবাসতে পেরেছেন, তারা আল্লাহ্কে ভালোবাসতে পেরেছেন। দয়াল রাসুলের আনুগত্য মানেই আল্লাহ্র আনুগত্য। তাই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, “যে রাসুলের আনুগত্য করল, সেতো আল্লাহ্রই আনুগত্য করল।” (সূরা নিসা ৪: আয়াত ৮০) হাদিসে কুদসিতে এরশাদ হয়েছে, “(হে হাবিব) আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না।” (তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০) দয়াময় আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন এবং আমাদেরকে তাঁকে ভালোবাসতে বলেছেন।
কুল কায়েনাতের রহমত হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের আনন্দে যারা আনন্দিত হন তারাই প্রকৃত ইমানদার। তাই তাঁকে বাদ দিয়ে শুধু কিতাব অনুসরণ করে ইসলাম ধর্ম পালন করা নিষ্ফল। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই ইমানের মূল। যিনি হযরত রাসুল (সা.)-কে যতটুকু ভালোবাসে তিনি ততটুকু ইমানদার। মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজানের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিশ্বময় হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেমের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আজ তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি, মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী মহামানব ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.)-এর আহ্বানে বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদ্যাপিত হচ্ছে।