দেওয়ানবাগ ডেস্ক: দেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু টিকার সফল পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই এ টিকা কার্যকর। টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে গত তিন বছরে কারো ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটেনি এবং অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আগে যাদের ডেঙ্গু হয়েছিল, তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি বেশি তৈরি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকরা বাংলাদেশে এই টিকার পরীক্ষা চালান।
এ টিকার নাম দেওয়া হয়েছে টিভি-০০৫ (টেট্রাভেলেন্ট)। তবে এটি দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা। এরপর তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা অন্য একটি দেশে হবে।
বাংলাদেশে এ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সাফল্য নিয়ে গত বুধবার ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস সাময়িকীতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরদিন গত বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এই সুখবর দেয় আইসিডিডিআরবি।
আইসিডিডিআরবি জানায়, টিভি-০০৫ টিকা পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন বয়সী ১৯২ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়। পরের তিন বছর তাদের পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকরা। গবেষণায় অংশ নেন মোট ১৯২ জন।
বয়সের চারটি শ্রেণিতে বাছাই করে অংশগ্রহণকারীদের টিকা দেওয়া হয়। অর্থাৎ, প্রতি দলে ৪৮ জন করে অংশ নেন। এসব ব্যক্তির কারো আগেই ডেঙ্গু হয়েছিল, আবার কারো হয়নি।
প্রাপ্তবয়স্ক ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে রয়েছেন ২০ জন পুরুষ ও ২৮ জন নারী। শিশু-কিশোর শ্রেণির ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে ২৭ জন পুরুষ ও ২১ জন নারী।
পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ১৫ জন পুরুষ ও ৩৩ জন নারী এবং এক থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৯ জন ছেলে ও ১৯ জন মেয়ে।
টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে গ্রহীতাদের কারো কারো গায়ে ফুসকুড়ি বা র্যাশ ছিল। দেখা গেছে, ২৬ শতাংশের র্যাশ, ১২ শতাংশের ফুসকুড়ি, ৫ শতাংশের জ্বর ও ৬ শতাংশের গিঁঠে ব্যথা ছিল। টিকা গ্রহণের ১৮০ দিন পর সব অংশগ্রহণকারীর মধ্যে বেশির ভাগ (১৪২ জন) সেরোটাইপের (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪) বিপরীতে সেরোপজিটিভ দেখা গেছে।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর টেট্রাভেলেন্ট ভ্যাকসিনের মতো একটি টিকা বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব গুরুতর হয়ে উঠছে। আশা করি, আমাদের কাজ ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর টিকা প্রাপ্তি ত্বরান্বিত করবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সিডিসি) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু টিকার প্রয়োগ নিয়ে একটি সফল গবেষণা হলো, এটা আশার দিক। যেহেতু আমরা এডিস মশা এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, ভবিষ্যতে পারব কি না, তা-ও জানি না। সুতরাং আমাদের বিকল্প প্রতিরোধ ব্যবস্থাটা হাতে থাকা দরকার। টিকা হলো তার মধ্যে অন্যতম।’
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে দুটি টিকা রয়েছে, সেটি নিয়েও এত দিন খুব বেশি আশ্বস্ত হতে পারিনি। যেহেতু দ্বিতীয় পর্যায়ের গবেষণা হয়েছে এবং সেটি বাংলাদেশে হয়েছে, সেখানে একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। যদি তৃতীয় পর্যায়ের গবেষণা সফল হয়, তাহলে সামনের দিনগুলো স্বস্তির হবে। তবে সেটি আগামী বছর বা এর পরের বছরও নয়। আরো বেশি সময় পর। কারণ টিকা পেতে এখনো বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে।’
বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘টিকা পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আরো উদ্যোগী হতে হবে। আমাদের কর্মকাণ্ড আরো বাড়াতে হবে। বিশেষ করে, কীটতাত্তি¡ক সমক্ষতা, রোগতাত্তি¡ক সক্ষমতা। এ কাজগুলো যদি স্থানীয় সরকার না পারে, সে ক্ষেত্রে সিডিসিকে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) এ দায়িত্ব নিতে হবে। মোট কথা, মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে রোগী কমানো যাবে না।’
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গুর টিকা দ্বিতীয় পর্যায়ে ট্রায়াল বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে সফল হয়েছে। এখন তৃতীয় পর্যায়ে ট্রায়াল করতে হবে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হবে এবং বিভিন্ন বর্ণের মানুষ থাকবে। সে ট্রায়াল সফল হলে আমাদের দেশের সরকার চাইলে অনুমোদন দেবে নিয়মমাফিক।’
তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর কোনো টিকার অনুমোদন দেয়নি। তারা ফলাফল দেখছে। দেশে ট্রায়াল হওয়া ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫-এর একটি সুবিধা হলো, এটি যে কাউকেই দেওয়া যাবে। ডেঙ্গু হোক বা না হোক, একই সঙ্গে চারটি ধরনের বিরুদ্ধে এটির প্রতিরোধক্ষমতা রয়েছে। আরেকটি সুবিধা হলো, ট্রায়ালে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেছে। একটি ভয় ছিল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে টিকা নিতে সব মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকে যাবে। যা হোক, সেটি হয়নি। যতটুকু জেনেছি, বাংলাদেশে এর তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল হবে না। সেটি হবে ভারতে। কারণ ভারতে অনেক রাজ্য। বিভিন্ন ধরনের মানুষ রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. শাহাদত হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু টিকার বিষয়ে টিকাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (নাইট্যাগ) সঙ্গে এক বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন ছাড়া আমাদের এখানে ব্যবহারের অনুমোদন দেয় না, সুতরাং তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল সফলভাবে হওয়ার পর এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিলে সেটি নিয়ে বাংলাদেশ ভাববে।’