আতাউর রহমান খসরু: পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়েকজন পর্যটক সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও চর্চিত তাদের অন্যতম ইবনে বতুতা। মরক্কোর অধিবাসী এই মুসলিম পর্যটক উত্তর আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত ৭৫ হাজার মাইল সফর করেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন ‘আর রিহলাহ’ গ্রন্থে। যাতে বিভিন্ন অঞ্চলের বহু জাতি, বর্ণ, ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বর্ণনা স্থান পেয়েছে তাতে।
প্রথম ভ্রমণ
ইবনে বতুতা ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে মরক্কোয় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন বতুতা। ইবনে বতুতা মূলত ইসলামি আইন নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। তবে তিনি ভ্রমণ করতেই বেশি পছন্দ করতেন।
মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি হজযাত্রায় বের হন। কিন্তু তা সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল ১৬ মাস। নৌপথের ঝুঁকি এড়াতে তিনি স্থলপথে কাফেলার সঙ্গে সফর করেন। তবে তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে যুদ্ধ, জাহাজ ধ্বংস ও বিদ্রোহের বিবরণ দিয়েছেন।
হজ থেকে বিশ্বভ্রমণের অনুপ্রেরণা
১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মভূমি টাঙ্গিয়ার থেকে ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি প্রথমে বের হয়েছিলেন পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য। কিন্তু মক্কায় বহু দেশের ও সংস্কৃতির মানুষের সম্মিলন তাঁকে বিশ্বভ্রমণে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি তাঁর ভ্রমণের সময় বহু অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, সমাজ ও সভ্যতা অবলোকন করেন। নিজের ভ্রমণকাহিনিতে তিনি এর বিবরণ তুলে ধরে পর্যালোচনা করেছেন। ‘রিহলাহ’ নামে পরিচিত হলেও বইটির প্রকৃত নাম ‘তুহফাতুন নাজ্জার ফি গারায়িবিল আমসার ওয়া আজায়িবিল আসফার’ (পর্যটকদের জন্য উপহার: বিভিন্ন শহরের বিরল ঘটনা ও সফরের বিস্ময়কর বিবরণ বিষয়ে)।
যেসব অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন
ইবনে বতুতা দীর্ঘ ৩০ বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি এই সময় ৭৫ হাজার মাইল বা এক লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেন। তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্ব, ভারতীয় উপমহাদেশ, চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চল সফর করেন। ফলে সময় ও ভ্রমণস্থলের বিবেচনায় তিনি ইতালিয়ান ব্যবসায়ী ও পর্যটক মারকো নেপালোর চেয়েও অগ্রগামী। ইবনে বতুতা প্রাক-আধুনিক যুগের একজন ব্যতিক্রম পর্যটক। তিনি হেঁটে, উটে চড়ে ও নৌপথে সমকালীন ৪০টির বেশি রাষ্ট্র অতিক্রম করেন। যার মধ্যে রয়েছে, আধুনিক মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মিসর, সিরিয়া, সৌদি আরব, ইয়েমেন, ওমান, তুরস্ক, রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল, ভারত, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ। রোমাঞ্চের নেশায় তিনি জীবনের নিরাপত্তাকেও তুচ্ছ করেছিলেন। এমনকি পিতার মৃত্যুর সময় তিনি পাশে ছিলেন না। এই ত্যাগ ও প্রত্যয়ের কারণে তিনি পৃথিবীর অন্যতম প্রধান পর্যটকের স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণের সময়কাল
ইবনে বতুতা লোহিত সাগর পাড়ি দেন এবং মক্কায় পৌঁছাতে আরবের বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চল অতিক্রম করেন। এরপর তিনি ইরাক ও ইরান ভ্রমণ করেন। ১৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে সাগর পাড় হয়ে এডেন হয়ে তানজানিয়া সফর করেন। ১৩৩২ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে বতুতা খাওয়ারিজম, বুখারা ও আফগানিস্তান অতিক্রম করে দিল্লিতে পৌঁছান। দিল্লির সুলতান তাঁকে বিচারক পদে নিযুক্ত করেন এবং তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে আট বছর অবস্থান করেন। ১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চীনের কুয়ানঝু শহরে অবতরণ করেন। চীন সফরের সময় বেইজিং, হ্যাংজু ও গুয়ানজুর মতো শহরগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি চীনের গ্রেট চ্যানেল ও গ্রেটওয়ালের প্রশংসা করেন। ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মরক্কোতে ফিরে যান। কিছুদিন অবস্থান করে স্পেন, সাহারা মরুভূমি ও মালি ভ্রমণ করেন। ১৩৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবারও মরক্কোতে ফেরেন। ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
যেভাবে লেখা হলো ‘রিহলাহ’
১৩৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে বতুতা মরক্কো ফিরে এলে মরক্কোর শাসক তাঁর কাছে মালির বিবরণ শুনতে চান। এরপর তিনি ইবনে বতুতার কাছে অন্যান্য স্থানের ভ্রমণের বর্ণনা জানতে চান। ইবনে বতুতার বিবরণ শুনে তিনি আগ্রহী হন এবং সুলতান ও তাঁর পরিবারের জন্য ভ্রমণকাহিনি লেখার নির্দেশ দেন। সুলতানের নির্দেশমতো ইবনে বতুতা মরক্কোর ফেজ শহরে অবস্থান করেন এবং তরুণ লিপিকার ইবনে জুঝাই তাঁর কাছে ভ্রমণ কাহিনিগুলো শুনে লিপিবদ্ধ করেন। ধারণা করা হয়, ইবনে বতুতার বর্ণনাকে ‘রিহলা’ তথা আরবি ভাষায় প্রচলিত ভ্রমণকাহিনির কাঠামো ইবনে জুঝাই দিয়েছিল। এমনকি কিছু কিছু তথ্যও সে সংযুক্ত করেছিল। যা বইটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ করেছে।
‘রিহলাহ’র ঐতিহাসিক মূল্য
আধুনিক ইতিহাস গবেষকদের কাছে ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনির বিশেষ মূল্য রয়েছে। কেননা তা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা ও মধ্যযুগের রাজনীতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। মরক্কোর ইতিহাস গবেষক হাসান আবদালি বলেন, ‘ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনি শুধু অনন্য শৈল্পিক মূল্যই রাখে না; বরং ভ্রমণকারী যে সময়ে বাস করছিলেন সে সময়ের বর্ণনা ও বিশ্লেষণও উপস্থাপন করে। যা এ সময় সেসময়কে বুঝতে সাহায্য করছে।’
মিসরীয় গবেষক ড. আহমদ বিন মুহাম্মদ আস সায়িদ বলেন, ‘যদিও ইবনে বতুতা তাঁর রিহলাতে (ভ্রমণকাহিনি) শিল্প ও সাহিত্যের উপাদানকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। তবু মনে রাখতে হবে, মরক্কোর মারিনিদ সুলতান আবু ইনান তাঁকে এসব অঞ্চলের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং বইটি খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতকের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।’