অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান মিয়া
মহান আল্লাহ্ সৃষ্টি জগতের সূচনা করেছেন হযরত রাসুল (সা.)-কে সৃজনের মাধ্যমে। আসলে নুরে মোহাম্মদী হচ্ছে সৃষ্টি জগতের প্রাণ। মহান আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-এর শান ও মর্যাদা সম্পর্কে ফরমান- “ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহ্মাতাল্লিল আলামিন।” অর্থাৎ- হে রাসুল (সা.) আমি তো আপনাকে জগতসমূহের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭) মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন এ বিশ্বজগতে ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবি রাসুল প্রেরণ করেছেন। সকল নবি রাসুলের ইমাম (ইমামুল মুরসালিন) হিসেবে জগতের বুকে যিনি আবির্ভূত হলেন, তাঁর শুভ জন্মদিন সকল সৃষ্টির জন্য রহমত ও বরকতে পরিপূর্ণ। এ দিবসকেই বলা হয় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)।
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান আল্লাহ্র প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-কে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ ঈদ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কেননা যাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ্ তায়ালা এ বিশ্বজাহানের কোনো কিছুই সৃষ্টি করতেন না, তাঁর শুভ জন্মদিনে আমাদের সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হওয়ার কথা। আর সে দিবসটিই আমাদের সবচেয়ে বড়ো ঈদের দিন হওয়া উচিৎ। কেননা, আমরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দিবসের যে দুটি ঈদ পেয়েছি, তা হযরত রাসুল (সা.)-এর সৌজন্যে, অথচ সেই নবির শুভ জন্মদিনটিই আমরা পালন করছি না। বরং সেক্ষেত্রে কোনো কোনো আলেম ফতোয়া দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। শুধু তাই নয়, উমাইয়া শাসনামলে চক্রান্ত করে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত একই দিবসে বলে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে মুসলমানদের মধ্যে এক চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের আনন্দ থেকে মুসলমান জাতি বঞ্চিত হয়েছে। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান সেই ভুল সংশোধন করে জাতিকে একটি সঠিক তথ্য প্রদান করেছেন। এটা সূফী সম্রাটের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। তিনি ইতিহাসের আলোকে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্ম ১২ই রবিউল আউয়াল। তাঁর ওফাত হয়েছে ১লা রবিউল আউয়াল। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, ১০ম হিজরি ৯ই জিলহজ শুক্রবার বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয়। এর ৮০ দিন পরে অর্থাৎ ৮১তম দিবসে হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত হয়। সেই হিসেবে ১লা রবিউল আউয়ালই হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত দিবস। অপরদিকে ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের ৫ দিন পূর্বে হয়েছে। অর্থাৎ হযরত রাসুল (সা.) ১১শ হিজরির সফর মাসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সফর মাসের শেষ বুধবার (২৫শে সফর) আবার সুস্থ হন। যাকে আখেরি চাহার শোম্বা বলা হয়। এর ৫ দিন পরে হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত হয়। তিনি এ বুধবারের পরে আর কোনো বুধবার পাননি। অর্থাৎ সোমবার তিনি ওফাত লাভ করেছেন। হিসেব অনুযায়ী যা ১লা রবিউল আউয়ালই হয়। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর সম্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মিলাদ পড়ার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলে অনেকেই হযরত রাসুল (সা.)-কে স্বপ্নে অথবা মোরাকাবায় দেখতে পান। অথচ এমন একটি সৌভাগ্য অর্জনের সুযোগ থেকে মুসলমান জাতি বঞ্চিত। আমরা যদি খ্রিষ্টান সমপ্রদায় দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাবো, তারা তাদের নবির জন্মদিনকে সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন বলে মনে করে থাকে। অথচ আমরা বিশ্বে প্রায় ১৭০ কোটি মুসলমান থাকা সত্তে¡ও মুসলমানজাতি তাদের প্রিয়নবি হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন পালন করা থেকে বিরত রয়েছে।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-কে যথেষ্ট মর্যাদাশীল করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ নিজেকে ‘রাব্বুল আলামিন’ এবং হযরত রাসুল (সা.)-কে ‘রাহ্মাতুল্লিল আলামিন’ বলেছেন। এ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বিশ্বজাহানের যতখানি ভূখণ্ডের জন্য রব বা প্রভু, মহানবি হযরত রাসুল (সা.) ততখানি ভূখণ্ডের জন্য রহমতস্বরূপ। অথচ আল্লাহ্র দরবারে এত মর্যাদা যাঁর, তিনি সকল নবি রাসুলের সর্দার, আমরা উম্মত হয়ে সেই রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) অনুষ্ঠানকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেই না। এটা আমাদের চরম অন্যায়। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) যদি মুসলমানগণ অত্যন্ত জাঁকজমক সহকারে এবং ধুমধামের সাথে পালন করত, তাতে মুসলমানদেরই কল্যাণ হতো। কিন্তু মুসলমানগণ তাদের প্রিয় নবির জন্মদিন পালন করতে তেমন আগ্রহী নয়। অথচ খ্রিষ্টান স¤প্রদায় তাদের নবি হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিনকে বড়োদিন হিসেবে পালন করে থাকে। আমরা মুসলমানগণ যে নবির উম্মত বলে দাবি করি, সেই রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন, আমরা তাঁর উম্মতেরাই তেমন পালন করি না। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন জাগে, আমরা যদি হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিনে আনন্দিত না হই; তাহলে হযরত রাসুল (সা.) আমাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করবেন কেন? মহান আল্লাহ্ এ জগতে যত নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই স্বজাতির কাছে শেষ এবং শ্রেষ্ঠ নবির জগতে আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা মুসলমানরা আমাদের রাসুলের সম্মান ও মর্যাদা উচ্চে তুলে ধরতে পারিনি। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি ও অন্যসকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মেন হতে পারবে না।” (বোখারী শরীফ-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭ এবং মুসলিম শরীফ-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯) তাহলে একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারি যে, যাঁকে ভালোবাসলে মানুষ ইমানদার হয়, তাঁর শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) আমাদেরকে অনেক জাঁকজমকের সাথে পালন করা অতীব জরুরি। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, আবু লাহাব একটা কুখ্যাত কাফের, সারা জীবন সে রাসুলের সাথে দুশমনি করেছে, অথচ মৃত্যুর পরে সোমবার দিবসে তারও আজাব লাঘব হয়ে থাকে। কেননা, হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্ম হলে আবু লাহাবের দাসী এ খবরটি তার কাছে পৌঁছানো মাত্রই সে ডান হাতের শাহাদত অঙ্গুলির ইশারা দিয়ে বলেছিল, আমার ভাতিজার জন্মের খবরটি দেওয়ার কারণে তোমাকে আমি মুক্ত করে দিলাম। হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের খুশিতে যে আঙুল উঠিয়ে ইশারা করে দাসীকে মুক্তি দিয়েছিল, প্রতি সোমবার সেই আঙুল থেকে এক প্রকার পানীয় বের হয়, যা পান করে তার এক সপ্তাহের পিপাসার জ্বালা মিটে যায়। একজন কাফেরের জন্য যদি আল্লাহ্ তায়ালা হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের খুশিতে আনন্দিত হওয়ার কারণে কঠিন আজাব লাঘব করতে পারেন, তাহলে আমরা মুসলমান হয়ে যদি রাসুলের শুভ জন্মদিনে আনন্দিত হই, নিশ্চয়ই তাতে হযরত রাসুল (সা.) নিজে এবং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনও খুশি হবেন। আর তাতে আমাদের জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে এবং এর ফলে আমাদের মুক্তির পথ সুগম হবে।
আমরা যদি হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করি, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের প্রতি হযরত রাসুল (সা.) সন্তুষ্ট হবেন এবং আমাদেরকে শাফায়াত করবেন।
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজানের সংস্কারগুলোর মধ্যে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন এবং মিলাদ শরীফ পাঠ উল্লেখযোগ্য। এর গুরুত্ব বুঝতে পেরে আজ দেশের প্রায় সর্বস্তরের মানুষ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) অনুষ্ঠান পালন করছেন। আমরাও পবিত্র মিলাদুন্নবি (সা.) অনুষ্ঠান ও মিলাদ পালন করে হযরত রাসুল (সা.)-এর রহমত ও শাফায়াত লাভ করে ধন্য হতে চাই। মহান আল্লাহ্ আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।