উপমহাদেশে মর্সিয়া সাহিত্যের বিকাশ ঘটে মোঘল আমল থেকেই। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবাব আলীবর্দী খাঁ ও তদীয় দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়ে মুর্শিদাবাদে যে কবিদের সমাগম হয়েছিল তাঁদের অনেকেই ছিলেন শিয়া অথবা নবিবংশের প্রতি মহব্বত পোষণকারী সুন্নি- যাঁদেরকে বলা হয় আহলে বাইতপন্থী সুন্নি। তাঁরা তরিকতপন্থীও বটে। তাঁদেরই প্রভাবে বাংলা মুল্লুকে মর্সিয়া সাহিত্যের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং সেটা পুঁথি সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। ফারসি-উর্দু ভাষার ধর্মীয় বোধ থেকেই বহু বাঙালি মুসলিম কবি মর্সিয়া ও পুঁথি রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে রাধারমণ নামে একজন হিন্দু কবিও রয়েছেন।
কারবালা ও মহররমের ঘটনা নিয়ে মধ্যযুগে ও পরবর্তীকালে যে সব পুঁথি ও বই লেখা হয়েছে সেগুলোর নাম ‘জঙ্গনামা’, ‘মকতুল হুসায়েন’, ‘শহীদ-ই-কারবালা’, ‘সংগ্রাম হুসেন’, ‘এমাম এ্যনের কিচ্ছা’, ‘শাহাদাত নামা’, ‘হানিফার লড়াই’, ‘বড় জঙ্গনামা’, ‘গুলজার-ই-শাহাদাত’, ‘দাস্তানে শহীদ ইকরামালী’, ‘জঙ্গে কারবালা’ ইত্যাদি। পল্লি বাংলার মানুষ কারবালার ঘটনা নিয়ে মহররম মাসে যে বিষাদময় গীতিকা গেয়ে থাকে তার নাম জারিগান। জারিগান মূলত আশুরার শোকগাথাকে নিয়েই রচিত হয়েছে। তাই বলা যায় জারিগান মহররমের বেদনাগাথার এক বিশেষ রূপ।
মধ্যযুগের কবিদের থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে আবুল মা-আলী, মুহাম্মদ হামিদ আলী, কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর রহমত আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ পর্যন্ত আশুরা বা কারবালাকেন্দ্রিক কাব্যচর্চা এক বিশেষ রূপ প্রাপ্ত হয়। কারবালা ট্র্যাজেডি নিয়ে বাংলা ভাষায় কে সর্বপ্রথম লিখেছেন তার সঠিক ইতিহাস খুঁজে না পাওয়া গেলেও একথা বলা যায়, আহমদ নগরের কবি আশরাফ প্রথমবারের মতো মর্সিয়া লিখেছিলেন। শায়খ ফয়জুল্লাহ কারবালা সম্বন্ধে ‘জয়গুনে চৌতিশা’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন যা এ সম্পর্কিত প্রথম বাংলা কবিতা বলে গণ্য করা হয়। বাহরাম খান নামে এক কবি লিখেন ‘মাকতাল হোসেন’। আরো লিখেন মুহাম্মদ খান নামে আরেক কবি। কারবালা নিয়ে আরো যেসব কবিতা রচিত হয় সেগুলো হলো কবি হায়াত মামুদের ‘কাশেমের লড়াই’, কবি হামিদের ‘সংগ্রাম হুসায়েন’, ফকির গরীবুল্লাহর ‘জঙ্গনামা’, কবি রাধারমণ-এর ‘এমাম এনার কিচ্ছা’, কবি মোহাম্মদ হামিদুল্লাহর ‘গুলজার-ই-শাহাদাত’, কবি মুহাম্মদ হামিদ আলীর ‘জয়নাল উদ্ধার’ ও ‘কাশেম বধ’, কবি মতিউর রহমান খান-এর ‘এজিদ বধ’ (যা অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত), কবি কায়কোবাদের ‘মহররম শহীদ’ (যা তিন খণ্ডে সমাপ্ত), কবি আবদুল বারীর ‘কারবালা’, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘মহাশিখা’, কবি আবদুল মুনায়েমের ‘পঞ্চশহীদ’, কবি মোহাম্মদ ইসমাইলের ‘শহীদের খুন’, কবি আবদুল হাকিমের ‘মরুসেনা’, মীর রহমাত আলীর ‘মর্হরম কাব্য’ ইত্যাদি।