প্রেম, নিষ্ঠা এবং ধৈর্য এই তিনটি জিনিস ছাড়া, আর কিছুরই দরকার নাই। উন্নতি, অর্থাৎ বিস্তার, অর্থাৎ প্রেম- এছাড়া আর জীবনের মূল্য কী? সুতরাং প্রেমই জীবন। প্রেমই জীবনের একমাত্র বিধান এবং স্বার্থপরতাই মৃত্যু। একথা ইহলোকে যেমন সত্য, পরলোকেও তাই। পরোপকারই জীবন এবং তাহা না করাই মৃত্যু। শতকরা নব্বইজন নরপশুই মৃত, প্রেততুল্য। কারণ, হে যুবকবৃন্দ, একমাত্র সেই জীবিত যে ভালোবাসতে জানে। তোমরা, যাহারা আমার সন্তান, তাহারা দরিদ্র, অজ্ঞ, নিপীড়িত জনগণের ব্যথা প্রাণে প্রাণে অনুভব করো; সেই অনুভবের বেদনায় তোমাদের বক্ষ ফেটে যাক, মস্তক ঘুরে উঠুক, তোমাদের পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হোক। তারপর হৃদয় নিঙড়ে ভগবানের পাদপদ্মে তোমাদের অন্তরের দুঃখ জানাও। তখন দেখবে তাঁর কাছ হতে শক্তি এবং সাহায্য আসবে; অদম্য উৎসাহে তখন তোমরা জ্বলে উঠবে।…হে আমার সন্তানগণ, ভয় পেও না। তারকাখচিত অনন্ত আকাশের দিকে ভয়ে ভয়ে চেয়ে ভেবো না, ঐ আকাশ তোমাদের পিষে ফেলবে। অপেক্ষা করো, দেখবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সবই তোমার পদতলে। ধৈর্য ধর। টাকাই বলো, নাম-যশই বলো, আর বিদ্যাবুদ্ধিই বলো-কিছুতেই কিছু হয় না। কেবল ভালোবাসাতেই সব হয়। চরিত্রই কেবল দুস্তর বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে পথ করে নিতে পারে। মানুষ হয়ে মানুষের জন্য যাদের প্রাণ না কাঁদে, তারা কি আবার মানুষ?
কর্তব্য বিশেষ রুচিকর নয়। প্রেম কর্তব্য-চক্রকে স্নেহসিক্ত করলে তবেই উহা বেশ সহজভাবে চলতে থাকে, নতুবা কর্তব্য ক্রমাগত সংঘর্ষ! অন্যথা কিভাবে পিতামাতা সন্তানের প্রতি, সন্তান পিতামাতার প্রতি, স্বামী স্ত্রীর প্রতি এবং স্ত্রী স্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করতে পারে? আমরা কি জীবনের প্রতিদিনই সংঘর্ষের সম্মুখীন হচ্ছি না? প্রেমমিশ্রিত হলেই কর্তব্য রুচিকর হয়। প্রেম আবার কেবল স্বাধীনতাতেই দীপ্তি পায়; কিন্তু ইন্দ্রিয়ের দাস, ক্রোধের দাস, ঈর্ষার দাস আরও যে শত শত ছোট ছোট ঘটনা জীবনে প্রত্যহ ঘটবেই, সেগুলির দাস হওয়াই কি স্বাধীনতা? আমরা জীবনে যেসব ছোটখাট রূঢ় সংঘর্ষের সম্মুখীন হই, ঐগুলি সহ্য করাই স্বাধীনতার সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি। নারীগণ নিজেদের ঈর্যাপূর্ণ খিটখিটে মেজাজের দাস হয়ে স্বামীর উপর দোষারোপ করে এবং মনে করে, তারা যেন নিজেদের স্বাধীনতা জাহির করছে। তারা জানে না যে, এইরূপে তারা নিজেদের দাসী বলেই প্রতিপন্ন করছে। যে সকল স্বামী সর্বদাই স্ত্রীর দোষ দেখে, তাদের সম্বন্ধেও এই একই কথা।
হে বৎস, যথার্থ ভালোবাসা কখনও বিফল হয় না। আজ হউক, কাল হউক, শত শত যুগ পরে হউক, সত্যের জয় হবেই, প্রেমের জয় হবেই। তোমরা কি মানুষকে ভালোবাস? ঈশ্বরের অন্বেষণে কোথায় যাচ্ছ? দরিদ্র, দুঃখী, দুর্বল-সকলেই কি তোমার ঈশ্বর নয়? অগ্রে তাদের উপাসনা করো না কেন? গঙ্গাতীরে বাস করে কূপ খনন করছ কেন? প্রেমের সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস করো। নামযশের ফাঁকা চাকচিক্যে কি হবে? খবরের কাগজে কি বলে না বলে, আমি সে দিকে লক্ষ্য করি না। তোমার হৃদয়ে প্রেম আছে তো? তবেই তুমি সর্বশক্তিমান। তুমি সম্পূর্ণ নিষ্কাম তো? তা যদি হও, তবে তোমার শক্তি কে রোধ করতে পারে? চরিত্রবলে মানুষ সর্বত্রই জয়ী হয়। ঈশ্বরই তাঁর সন্তানগণকে সমুদ্রগর্ভে রক্ষা করে থাকেন!
সমষ্টির জীবনে ব্যষ্টির জীবন, সমষ্টির সুখে ব্যষ্টির সুখ, সমষ্টি ছেড়ে ব্যষ্টির অস্তিত্ব অসম্ভব, এ অনন্ত সত্য-জগতের মূল ভিত্তি। অনন্ত সমষ্টির দিকে সহানুভূতিযোগে তার সুখে সুখ, দুঃখে দুঃখ ভোগ করে শনৈঃ অগ্রসর হওয়াই ব্যষ্টির একমাত্র কর্তব্য। শুধু কর্তব্য নহে, এর ব্যতিক্রমে মৃত্যু- পালনে অমরত্ব।
যদি একজনের মনে-এ সংসার-নরককুন্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেটুকুই সত্য, এই তো আজন্ম ভুগে দেখছি- বাকি সব ঘোড়ার ডিম।
[স্বামী বিবেকানন্দের ‘ব্যক্তিত্বের বিকাশ’ গ্রন্থের একটি অধ্যায় থেকে সংকলিত]