হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন: রুগ্ন থেকে সফল আর্থিক প্রতিষ্ঠান

হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন: রুগ্ন থেকে সফল আর্থিক প্রতিষ্ঠান

বাণিজ্য ডেস্ক: সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ। গত জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এই সময়ে খেলাপি ঋণে সর্বনিম্ন অবস্থানে থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি)। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩.৮০ শতাংশ।

তবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অবনতির মূল কারণ হিসেবে খেলাপি ঋণকেই চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। বহুজাতিক জায়ান্ট স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের সঙ্গে একসময় রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংককে তুলনা করা হয়েছে। ওই ব্যাংকটি সব অর্জন বিসর্জন দিয়ে এখন শীর্ষস্থানীয় খেলাপির কাতারে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণ কার্যক্রমে আর্থিক খাতে সাফল্য অর্জন করে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ফ্ল্যাট ক্রয় ও বাড়ি নির্মাণের জন্য ঋণদাতা বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিএইচবিএফসি।
বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজই হলো গৃহঋণ বিতরণ। পাশাপাশি সংস্থাটি ফ্ল্যাট নিবন্ধন, আবাসন উন্নয়ন ও মেরামত এবং বাড়ি নির্মাণে সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্যও ঋণ দিয়ে থাকে।

জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই একসময় খেলাপি ঋণের ভারে বিধ্বস্ত ছিল বিএইচবিএফসি। ২০০১ সালেও প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৫ শতাংশের বেশি। রুগ্ন এই প্রতিষ্ঠানটির ক্রমাগত খেলাপি ঋণের হার বর্তমানে ৩.৮০ শতাংশে নেমে এসেছে, যা দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের গড় খেলাপি ঋণের হারের চেয়েও কম।

গত অর্থবছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬০ কোটি ৩১ লাখ টাকায় নেমেছে। আগের অর্থবছরেও ছিল ১৮২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এক যুগ আগেও এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ বা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে সামষ্টিক ঋণ আদায়ও এ বছরই সবচেয়ে বেশি, যার পরিমাণ ৭১৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

ঋণ আদায়ে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ আদায় হয়েছিল ৬৫২ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং তার আগের অর্থবছরে হয়েছিল ৫৬৫ কোটি টাকা। শুধু শ্রেণীকৃত ঋণ আদায়ই নয়, ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে ঋণ মঞ্জুরি, ঋণ বিতরণ, অশ্রেণীকৃত ঋণ আদায় এবং বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তিতেও। ঋণ মঞ্জুর ও ঋণ বিতরণে গত অর্থবছরে উভয় ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশেরও বেশি।

বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানটি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রেখেই দিনের পর দিন ব্যবসা সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে। গত অর্থবছরে ৬৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করলেও চলতি অর্থবছরে সব রেকর্ড ভেঙে ঋণ বিতরণ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক মুনাফা গত এক যুগে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে।

ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা নির্দেশক সব সূচকে রেকর্ড সাফল্যের ফলে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফাও অর্জন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি। গত অর্থবছরে করপূর্ব মুনাফার পরিমাণ ২৭৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। তিন বছর আগেও বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ ছিল ১৬৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। করোনা মহামারির মধ্যেও প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা বাড়িয়ে এগিয়ে গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির গত দুই যুগের ইতিহাস দেখলে বুঝা যায় রুগ্ন থেকেও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান সফল হতে পারে। অতীতে ঋণ বিতরণ ও আদায়ে স্বচ্ছতার ঘাটতির কারণে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ঋণ শৃঙ্খলার ঘাটতিতে ছিল। গত এক যুগে রুগ্ন পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। ঋণ বিতরণে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতাকে প্রাধান্য দেওয়ায় খেলাপি ঋণে সাফল্য এসেছে। এ কারণে এখন আগের চেয়ে বেশি ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারছে।

এ বিষয়ে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মান্নান বলেন, নিবিড় পর্যবেক্ষণ খেলাপি ঋণ কমিয়ে সাফল্য এনে দিয়েছে। তাছাড়া আগের চেয়ে জনবল বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে তদারকিতে জোর দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির মাধ্যমে জবাবদিহি রয়েছে। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছি। গ্রাহকদের সমস্যা চিহ্নিত করে দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। এর ফলে বিএইচবিএফসি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’
আব্দুল মান্নান বলেন, খেলাপি ঋণে যেমন সফল হয়েছে বিএইচবিএফসি, তেমনি ঋণ বিতরণ কার্যক্রমও বাড়ানো হয়েছে। আগে একটি শাখা দিয়ে দেশের দুই, তিন জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এখন প্রতিটি জেলায় শাখা রয়েছে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইএসডিবি) থেকে ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে।


গত মে মাসে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত সংস্থাটির ২০২৩ সালের বার্ষিক সভায় ২৭০.৫৭ মিলিয়ন ইউরো বা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার এই ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিএইচবিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সর্বনিম্ন পাঁচ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২৫ বছর মেয়াদি ঋণ দিলেও তা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া ঋণের সুদ কম। সর্বনিম্ন ৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *