জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবেশের প্রভাব অত্যধিক; কিন্তু এ পরিবেশগত উন্নয়নকে আমরা তেমন তোয়াক্কা করছি না। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দেখা যাচ্ছে, রাস্তাঘাটের পাশাপাশি হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, আবাসিক এলাকা, পার্ক প্রভৃতি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে জনগণের সচেতনতার অভাবও বিদ্যমান। কেউ কেউ মনে করতে পারেন, তারা ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভাগাড় তৈরি করলেও তা পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে সরকারের। আরও স্পষ্ট করে বললে স্থানীয় সরকারের। স্থানীয় সরকারগুলি তাদের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করবে নিশ্চয়ই; কিন্তু জনগণ সচেতন না হলে এ কাজ হবে কঠিন ও জটিলতর।
আমরা জানি, ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’ বা ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য সকল নাগরিকের স্বাস্থ্যসচেতনতা সর্বাগ্রে জরুরি। দৈনন্দিন কাজকর্মে, খাদ্যাভ্যাসে ও অসুখবিসুখের ব্যাপারে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও স্বাস্থ্যসচেতনতার মাধ্যমে আমরা সুস্থ জীবনযাপন করতে পারি। আসলে স্বাস্থ্যের উপর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাব মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। কেননা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ হতেই সংক্রামক ব্যাধি তথা রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটে। দূষিত পানি, দূষিত বায়ু, পচা-বাসি খাবার, উন্মুক্ত জায়গায় ও অস্বাস্থ্যকরভাবে প্রস্তুত খাবার গ্রহণ, আবর্জনা ও মলমূত্র নিষ্কাশন অব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, স্যাঁতসেঁতে বাসস্থান ও কর্মস্থল ইত্যাদি রোগ বিস্তারে সহায়তা ও স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করে। বিশুদ্ধ পানি, মুক্ত বাতাস, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, আলো ও বাতাসময় পরিবেশ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর সুষম খাদ্য ইত্যাদি সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। এসকল জ্ঞান সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সম্যক ধারণা থাকা দরকার।
আমরা বরাবরই বলে আসছি যে, দেশের নদনদী, খালবিল, জলাশয় ও পুকুর ইত্যাদি দখল ও দূষণের হাত হতে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে জনগণকে সচেতন হতে হবে। তারা যদি নিজেদের ময়লা-আবর্জনা আশপাশের খাল-বিল ও নদী-নালায় না ফেলেন এমনকি যারা ফেলছে তাদের সচেতন করতে বা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন, তাহলেই স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন সম্ভব। পরিবেশগত উন্নয়ন এজন্য আজ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সমগ্র বিশ্বে; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলি এখনো এই ব্যাপারে বহুলাংশে বেখেয়াল ও বেহুঁশ। অথচ সমগ্র দেশকে গার্বেজে পরিণত করে কোনো জাতি সুস্থ ও সবল থাকতে পারে না। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও ব্যবস্থাপনায় একে আমরা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি? স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবেশ উন্নয়নের প্রতি আমাদের মনোযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দুই মাসে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। আমরা যদি এই সময়টায় মশক নিধনের পাশাপাশি জনসচেতনায় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিতে পারতাম, তাহলে পরিস্থিতি এতটা অসহনীয় হতো না। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এমন সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। তবে তারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এডিশ মশার লার্ভা ধ্বংসে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়ায় এবং ঘরে ঘরে সচেতনতা গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়ায় তাদের এ সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম। তাই স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সচেতনতার ক্ষেত্রে মহল্লায় মহল্লায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছুদিন পূর্বে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে, বিশ্বের অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতিমধ্যে ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, সুইডেন প্রভৃতি ডেঙ্গু প্রবণ দেশে ফ্রান্সের তৈরি ডেঙ্গু ভ্যাক্সিয়া ও জাপানের তৈরি কিউডেঙ্গা টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও ডেঙ্গুর টিকা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগের চিন্তাভাবনা চলছে। এতে আমরা আশান্বিত হতে পারি। তবে এর পরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন, স্বাস্থ্যশিক্ষার বিস্তার ও সতর্কতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নাই। কেননা ইহার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য অসুখবিসুখ হতেও পরিত্রাণ লাভ করতে পারি সহজেই।