অধ্যাপক মো. সোলায়মান আলী সরকার
পূর্ব প্রকাশিতের পর
ইউরোপীয় দর্শন সতের শতক হতে শাস্ত্র প্রাধান্য উপেক্ষা করে স্বজ্ঞাবাদের উপর ঈশ্বরতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে। দেকার্ত সহজাত ধারণার উপর ঈশ্বরতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কার্যমাত্র একটা কারণ আছে, এটা একটা সহজাত ধারণা। প্রত্যেক কার্যের কারণ তার অনুরূপ, এটাও একটা সহজাত ধারণা। এই সব ধারণার সত্যাসত্য বাইরের প্রমাণের উপর নির্ভরশীল নয় এবং এইগুলি স্বজ্ঞাজাত সত্য ধারণা। দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্রাহ্ম চিন্তাবিদের মতে ‘আত্মা প্রত্যয়’ জাত ধারণা বা সহজ জ্ঞান। এই সকল ধারণার বাইরের প্রমাণের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং এইগুলি স্বজ্ঞাজাত সতঃসিদ্ধ সত্য ধারণা, এইগুলি দিয়ে যাবতীয় বিষয়বস্তুর সত্যতা নির্ধারিত হয়, হৃদয় দিয়ে এ সবগুলির সত্যতা যাচাই করা হয়। এটা নিরেট যুক্তিবাদ নয়, সংশয়মূলক যুক্তিবাদ নয় কিংবা রামমোহন, অক্ষয় কুমার দত্ত ব্রাহ্ম দর্শনের যুক্তিবাদ, ডিরোজিও প্রভাবিত ইয়ং বেঙ্গলদের নিরীশ্বরবাদী ও প্রকৃতিবাদী বুদ্ধিবাদ নয়, এটা প্রাচ্য জগতের, বাংলাদেশ ও ভারতের আস্তিকবাদী দার্শনিকদের মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র সেন, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রমুখ ব্রাহ্ম দার্শনিকদের, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতামূলক স্বজ্ঞাবাদ, সহজ জ্ঞানবাদ, আত্ম প্রত্যয়বাদ, অপরোক্ষ জ্ঞানবাদ, সুফি পরিভাষায় ‘ইলমে ইন্দিল্লা’, ‘ইলমে সিনা’, ‘ইলমে লাদুন্নী’, বা ‘দিব্যজ্ঞান, মতবাদ। এর মধ্যে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি বা যুক্তির উপাদান আছে ও প্রেম-ভাব-ভক্তির উপাদান বর্তমান রয়েছে। এর সাথে সুফি দার্শনিক ইবনুল আরাবি, জালাল উদ্দিন রুমি, আব্দুল কাদির জিলানি, মনসুর হাল্লাজ, সোহরাওয়ার্দি মকতুল, নিযাম উদ্দিন আউলিয়া, ইকবাল প্রমুখ সুফির স্বজ্ঞাবাদ, বাংলাদেশের সুফি ও সুফি যোগসাধক, নব্য সুফি যোগসাধক ও লৌকিক মরমী সাধক কবি শেখ জাহিদ, শেহ ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, হাজী মোহাম্মদ, সৈয়দ আলাওল, আব্দুল হাকিম, শেখ চাঁদ, সৈয়দ মর্তুজা, আলী রজা, হাসন রাজা, শুকুর মাহমুদ, রমজান আলী রহিমুদ্দিন মুনশী, হায়াত মাহমুদ, লালন শাহ, সাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ প্রমুখ মরমী সাধকদের স্বজ্ঞাবাদ, সাধনাজাত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাবাদ, যোগশ-প্রত্যক্ষবাদ, বাংলার বৈষ্ণবদের প্রেম-ভাব-ভক্তিমূলক মতবাদ, সহজিয়া সাধকদের সহজ জ্ঞানবাদ, নাথ, বাউল প্রমুখ মরমী সাধকদের যোগশ প্রত্যক্ষবাদের যথেষ্ট মিল আছে।
রামমোহন প্রমুখ বুদ্ধিবাদী ব্রাহ্ম চিন্তাবিদের যুক্তিবাদী জ্ঞানতত্ত্বের সমালোচনা করতে গিয়ে লালন বলেন, যারা যুক্তি দ্বারা ‘নাম ব্রহ্মসার’ করেন বা কেবলমাত্র নাম ব্রহ্ম জপ করেন, তারা বস্তুর সন্ধান পান না কারণ, তাদের মতে নিরাকার, নির্গুণ, অজ্ঞেয় ও অজ্ঞাত অভেদ ব্রহ্ম। নির্গুণ, নিরাকার পরব্রহ্মের জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। লালন বলে যেমন বিনা ‘হাইল’ বা ‘দাঁড়ে’ নৌকা সঠিকভাবে চলে না, তেমনি নিরাকার ও নির্গুণ ব্রহ্মকেও জানা যায় না। যুক্তিবাদী নির্গুণ নিরাকার ব্রাহ্মবাদীদের যুক্তিবাদ অজ্ঞেয়তাবাদ ও সংশয়বাদের নামান্তর। অক্ষয় কুমার সরকার, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখ প্রত্যক্ষবাদী চিন্তাবিদের মত ‘দাহিরিয়ার ন্যায় অদেখার প্রায়’ দেখে সংশয়বাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পক্ষপাতী তিনি নন। তিনি সহজ জ্ঞান, দিব্যজ্ঞান, ইলমে সিনার জ্ঞানের কথা বলেন। তিনি যে সহজ জ্ঞান, দিব্যজ্ঞান, ‘ইলমে সিনা’, ইলমে লাদুন্নী’ ইত্যাদির কথা বলেন, তার সাথে দেবেন্দ্রনাথের আত্ম প্রত্যয়ের যথেষ্ট মিল থাকা সত্ত্বেও তা অতি মাত্রায় ইসলামি রঙে রঞ্জিত, আর, পারস্য, মিশরের সুফি-মরমী সাধনা, বাংলার নব্য সুফি ও নব্য মরমী সাধনা আবৃত যদিও তার মধ্যে বাংলার প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া, নাথ সাধনা, তান্ত্রিক সাধনা, বাউল ইত্যাদির বহু উপাদান বর্তমান আছে। লালনের পরম ব্রহ্ম কেবলমাত্র যুক্তিতর্ক বা মৌখিক আত্ম প্রত্যয়, শব্দ ব্যবহার, খোল করতাল, হারমোনিয়াম, সুর-তাল-লয়-যোগে পাওয়া যায় না। এ পরম ব্রহ্ম হেগেলের ‘পরম চিন্তা’, এ চিন্তাকে এক দিকের বিচারে যুক্তিতর্কের সাহায্যে ধরা, ছোঁয়া ও স্পর্শ করা যায় না, ভাষা-বাক্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া যায় না। এর সাথে বেদান্তের নিরাকার ব্রহ্ম, অচিন ব্রহ্ম, অভেদ ব্রহ্ম বা ‘নিরাকার লা শরিক আল্লাহ্র’ যথেষ্ট সামঞ্জস্য বর্তমান। পরম চিন্তার জ্ঞান লাভের জন্য হেগেল দ্বাম্বিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যুক্তি তর্কের সাহায্য গ্রহণ করেন আর বাংলার নৈয়ায়িক ও নব্য নৈয়ায়িকরা তর্কশাস্ত্রের আশ্রয়ে যুক্তির অবতারণা করেন, লালন, জালালউদ্দিন রুমীর মত, বৈজ্ঞানিক যুক্তির পথ অতিক্রম করে কুতর্ক ত্যাগ করে স্বজ্ঞার আশ্রয় গ্রহণ করেন।
জৈন দর্শনে কেবল জ্ঞান তথ্য স্বজ্ঞাজাত জ্ঞান বা দিব্যজ্ঞানের অধিকারী ছাড়া জৈন নৈয়ায়িকরা ন্যায়তত্ত্ব, স্ব্যাদ-বাদ বা তর্কের মাধ্যমে বস্তুর জ্ঞান লাভ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। অনুমান সম্পর্কে তারা বলেন, ন্যায়ের নিয়মাবলি যথাযথ অনুসরণ করে ‘অনুমান’ করা হলে সে অনুমানলব্ধ, জ্ঞান যথার্থ জ্ঞান হয়। তাদের আধ্যত্মিক আদর্শের সাথে লালনের চিন্তাধারার মিল থাকা সত্ত্বেও তিনি তাদের ন্যায়তন্ত্রের সাথে একমত হতে পারেন নি। তারা জ্ঞানের বস্তুর বহু গুণের বা ধর্মের এক বা একাধিক গুণ স্বীকার করেন। কোনো বস্তুর একটি বিশেষ গুণ বা ধর্ম সম্পর্কিত আংশিক জ্ঞানকে ‘ন্যায়’ বলা হয়। জ্ঞানের বাক্য বা অবধারণগুলির প্রত্যেকটি এক একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ হতে গঠন করা হয় এবং সেই দৃষ্টিকোণের বিচারে বাক্যটি সত্য হয়। এক বস্তু সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরস্পর দুই ততোধিক বাক্য গঠন সম্ভব। কোন বাক্য, অবধারণ, বা ন্যায় চরম সত্য নয়, একটা বিশেষ দিক বা বিশেষ দৃষ্টিকোণের বিচারে তা সত্য। বাক্য বা অবধারণের এই ভাব প্রকাশের জন্য জৈন নৈয়ায়িকরা প্রত্যেকটি বাক্যের পূর্বে ‘স্যাদ’ অর্থাৎ ‘একদিক থেকে’ কথা জুড়ে দেন আর এ কারণে তাদের এ মতবাদকে ‘স্যাদ’-বাদ বলে। প্রত্যেক বাক্যের সত্যতা শর্তাধীন বা শর্তসাপেক্ষ, আর এ কথা প্রকাশ করা স্যাদবাদের মূল উদ্দেশ্য। এই বাক্য বা ন্যায় সপ্তভঙ্গী ন্যায়। স্যাৎ-অস্তি, স্যাৎ-নাস্তি, স্যাৎ-অস্তি-নাস্তি, স্যাৎ অবক্তব্য ইত্যাদি বাক্য, বস্তু সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী দুই বা ততোধিক উক্তিকে সত্য হিসাবে স্বীকার করা অপেক্ষা মরমী সাধকদের মরমী অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমগ্র বস্তুটি প্রত্যক্ষ করে অখন্ড সত্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ প্রক্রিয়া পছন্দ করেন। তিনি বলেন, “সপ্তপন্থীর মতো সপ্ত রূপ বেষ্টিত/রসিকের মন নয় তাতে রত। জৈন মতে, একই বস্তু অস্তি ও নাস্তি, আছে ও নাই, নিত্য ও অনিত্য, সত্য ও মিথ্যা ও উভয়ই হতে পারে। লালন বলেন, এমন মতবাদে বিশ্বাসীরা যেন অন্ধকারের মধ্যে বস্তু বা সত্তার স্বরূপ আংশিকভাবে প্রত্যক্ষ করে থাকেন, তাঁরা বস্তু বা সত্তার পূর্ণ স্বরূপ অখন্ডভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন না। স্যাৎবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অথচ তীব্র সমালোচনা দ্বারা তিনি এই জ্ঞান প্রক্রিয়াকে অন্ধকার ঘরে সাপ ধরার সাথে তুলনা করে বলেন, “অন্ধকার ঘরে সর্প ধরা/আছে সাপ নাই সাপ তাই করা।” তিনি বলেন, তারা কেবলমাত্র যুক্তিতর্ক বা তার্কিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরমার্থিক জ্ঞান লাভে বিশ্বাসী, তারা যেন ‘বুদ্ধি হারা পাগলের প্রায়’।
বিচার বুদ্ধি, তর্ক মনে সংশয় জন্মায়, বিচার বিশ্লেষণ সময় সময় সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায় সত্য, কিন্তু সত্যকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে না। মানুষের নৈতিক বিশ্বাস যে অখন্ড শুভবুদ্ধি বা সুবুদ্ধির প্রেরণা দেয়, তারই ফলে মানুষের পরকালে আত্মার অবিনশ্বরত্বে ও মঙ্গলময় ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। দার্শনিক যুক্তি কুটতর্কে সাহায্যে পরকাল প্রমাণ করা যায় না, মানবাত্মা অমর, এ কথা প্রমাণ করা যায় না, আর ভালো মন্দে মিশানো এই জগতের পিছনে তার নিয়ন্তা পরম মঙ্গলময় ঈশ্বর বা আল্লাহ আছেন, এ কথাও দার্শনিক যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু এই সমস্ত সত্যে বিশ্বাস নীতিবোধ ও শুভবুদ্ধির সার কথা। যুক্তি বা তর্ক অনেক সময় পরাতাত্ত্বিক সত্তাকে অস্বীকার করে সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়তাবাদী, নাস্তিকবাদী, নিরীশ্বরবাদী ও ভোগবাদী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যা নীতি বিজ্ঞান ও ধর্ম সমস্ত আস্তিকবাদী ও ঈশ্বরবাদী ধারণায় উপনীত হতে সাহায্য করে না, তা লালন শাহের মতে, সুবুদ্ধি বা সুযুক্তি নয়, বরং কুযুক্তি, কুতর্ক মাত্র। চার্বাক, লোকায়ত, জৈন, বৌদ্ধ দর্শন, আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী, প্রত্যক্ষবাদী, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী, ইয়ং বেঙ্গল দল প্রমুখের প্রকৃতিবাদী, সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়তাবাদী, নিরীশ্বরবাদী দর্শন যথেষ্ট পরিমাণে যুক্তিবাদী দর্শন হওয়া সত্ত্বেও সেগুলি ঈশ্বর, আত্মা, পরকাল, শেষ বিচার ইত্যাদি অস্বীকার করে বলে লালন সেগুলির সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেন নি। তিনি কান্টের মতো যুক্তির খাতিরে যুক্তি করেন না বা তর্ক করেন না বরং আস্তিকাবাদী ধ্যান ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তির অবতারণা করেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, “কুতর্কের দোকান সে করে না আর।” যুক্তি তর্ক বা বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে তিনি বলেন যে তিনি আর কুতর্ক করেন না। বিচারবাদী দার্শনিক কান্ট আধ্যাত্মিক জগতের স্বগত-সত্তার জ্ঞান লাভের জন্য যুক্তি ও তর্কের পথ ত্যাগ করে একজন বিশ্বাসীর মত নৈতিক যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন। পির, ফকির, আউলিয়া, সুফি, দরবেশ, মরমী দার্শনিক, সাধক, প্রেমিক, ভক্ত প্রভৃতি যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসের পথকেই সহজ সরল পথ বলে মনে করেন। বাংলার ভক্তিবাদী বৈষ্ণব সাধক ও দার্শনিকরা যুক্তিতর্ক বিচার অপেক্ষা বিশ্বাসের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। বৈষ্ণব কবির উক্তি: “বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ, তর্কে বহু দূর।” লালন বিশ্বাস ও যুক্তি তথা ধর্ম ও দর্শনের সম্বন্ধ নির্ণয়ে, পরমাত্মার সাক্ষাৎ জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে কান্টের কথা, ধর্মীয় ভাবধারা প্রভাবিত ইমানদার মুসলমান সুফি, ফকির, দরবেশ, আউলিয়া ও বাংলার ভক্তিবাদী বৈষ্ণব সাধক-চিন্তাবিদ প্রমুখের কথার সহজ সরলভাবে পুনারাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, “বহু তর্কে দিন বয়ে যায়, বিশ্বাসে ধন নিকটে রয়। সিরাজ সাঁই ডেকে লালনকে কয়, কুতর্কের দোকান খুলিসনে আর। বা “বহু তর্কে দিন বয়ে যায়। বিশ্বাসে ধন নিকটে পায়।”
চলবে