যেভাবে বিশুদ্ধতম ভাষার অধিকারী হন মহানবি (সা.)

যেভাবে বিশুদ্ধতম ভাষার অধিকারী হন মহানবি (সা.)

আতাউর রহমান খসরু: হযরত রাসুল (সা.)-এর পুরো জীবনটাই ছিল আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার অধীন। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় নবিজি (সা.) এমনভাবে লালিত-পালিত হন যে জাহেলি যুগের কোনো কলুষতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি, অথচ তিনি সময় ও সমাজ থেকে জীবনের সব কল্যাণ ও পাথেয় অর্জন করতে পেরেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সেই পরিকল্পনাকে এভাবে চিত্রিত করেছেন, ‘তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পাননি আর তোমাকে আশ্রয় দান করেননি?’ (সূরা দুহা, আয়াত ৬)
তেমনি এক কল্যাণ হলো বিশুদ্ধতম ভাষা অর্জন করা। মহানবি (সা.) ছিলেন আরবের বিশুদ্ধতম ভাষার অধিকারী।

মহানবি (সা.)-এর ভাষাগত দক্ষতা
শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভাষা সম্পর্কে লেখেন, হযরত রাসুল (সা.)-এর মুবারক ভাষার বিশুদ্ধতা, একই বাক্যে বহু বাক্যের সমাবেশ, অভূতপূর্ব বর্ণনাভঙ্গি, অমূল্য নির্দেশ ও সমাধান এত বেশি থাকত, যা কোনো গবেষক ও চিন্তাবিদ কোনো সীমা ও গণনার মধ্যে আবদ্ধ করতে পারবেন না। তাঁর ভাষার মাধুর্য, গভীরত্ব ও সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহ্ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে অধিক শুদ্ধ ও সুমধুর ভাষার অধিকারী কাউকে সৃষ্টিই করেননি। (মাদারিজুন নুবুওয়াহ : ১/৩৫)

আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ
আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে মহানবি (সা.)-কে ভাষার ঐশ্বর্য দান করেছিলেন। একবার ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মহানবি (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন যে, হে আল্লাহর রাসুল! না আপনি বাইরে ভিনদেশে কোথাও গেছেন, না আপনি বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন, তবু আপনি এত সুন্দর শুদ্ধভাষা কোথা থেকে পেলেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ইসমাইল (আ.)-এর ভাষা ও পরিভাষা, যা দুষ্প্রাপ্য ও বিলীন হয়ে গিয়েছিল, তা আমার কাছে জিবরাইল (আ.) নিয়ে আসেন এবং তা আমি আত্মস্থ করেছি। উপরন্তু তিনি বলেন, আমার প্রভু আমাকে (আদব) ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন, ফলে আমার ভাষাকে অতি উত্তম করে দিয়েছেন। যে শিক্ষা আরবি ভাষা, তার শুদ্ধতা, অলংকার, সৌন্দর্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাকে আরবরা আদব বলে। (মাদারিজুন নুবুওয়াহ: ১/৩৫)

যেভাবে বিশুদ্ধতম ভাষা অর্জন করেন
কোনো সন্দেহ নেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভাষাজ্ঞান ও এর উৎকর্ষ আল্লাহর একান্ত দানই ছিল এবং তা তাঁর জন্য মুজিজাও বটে। তবু সিরাত গবেষকরা তাঁর ভাষাগত দক্ষতার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে পার্থিব উপলক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

১. শৈশবে ভাষার পাঠ: কুরাইশ গোত্রের অভ্যাস ছিল তারা তাদের সন্তানদের গ্রামে পাঠিয়ে দিত। যেন তারা বিশুদ্ধ ও অলংকারমণ্ডিত ভাষা এবং মনের ভাব প্রকাশের সুন্দর রীতি শিখতে পারে। এ জন্য আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্তন্যদানকারী নারীরা মক্কায় আসতেন। তাঁরা সাধারণত মক্কার ধনী পরিবারের সন্তানদের বেছে নিতেন। যেন তাঁরা মূল্যবান উপহার লাভ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের পর বনু সাআদ গোত্রের হালিমা সাদিয়া (রা.) মক্কায় দুগ্ধপোষ্য শিশুর সন্ধানে আসেন। কিন্তু এতিম হওয়ায় নবিজি (সা.)-কে গ্রহণ করতে প্রথমে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর ভাগ্য প্রসন্ন হলো এবং তিনি এতিম শিশুকে সঙ্গে নিয়ে চললেন। এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) শহরের কোলাহল ও মিশ্র ভাষা থেকে দূরে চলে যান এবং বিশুদ্ধ ভাষারীতি আত্মস্থ করতে থাকেন। বনু সাআদ গোত্রের এক নিভৃত পল্লীতে আল্লাহ তাঁকে বিশুদ্ধ ভাষা রপ্ত করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কেননা তা দ্বিনি দাওয়াতের একটি মৌলিক দাবি। নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের সময় সুস্পষ্ট ও উৎকৃষ্ট ভাষায় দাওয়াত না দিলে তা ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। (তুফুলাতুন নাবি, পৃ. ১৪-১৭)

২. কৈশোরে ভাষার পাঠ: এরপর হযরত রাসুল (সা.) দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন। যাঁরা মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং হজের সময় তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের কাছে মক্কা ও তার বাইরের গোত্রপ্রধান, অভিজাত ব্যক্তি, কবি-সাহিত্যিক, বক্তা ও পণ্ডিতরা আগমন করতেন। ফলে নবিজি (সা.) তাঁদের ভাষার বৈভব থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পান। এছাড়া পবিত্র কাবার দেওয়ালে সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতা ঝোলানো থাকত। যে কবিতাগুলো মক্কাবাসীর মুখে মুখে আবৃত্তি হতো। এটাও নবিজি (সা.)-এর ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিল। (তুফুলাতুন নাবি, পৃ. ১৪-১৭)

৩. যৌবনে ভাষার পাঠ: মক্কা ও আশপাশের বাজারগুলোতে নবিজি (সা.) বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গমন করতেন। এসব বাজারে নিয়মিত সাহিত্যের আসর ও প্রতিযোগিতা হতো। এতে তিনি সমকালীন কবি ও সাহিত্যিকদের সাহিত্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার সুযোগ পান। আরবের বিখ্যাত ও সমকালীন কবিদের সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। নিম্নোক্ত হাদিস থেকে যার ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘কবিরা যেসব কথা বলেছেন, তার মধ্যে কবি লাবিদের কথাটাই সর্বাধিক সত্য। (সে বলেছে) শোন! আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই বাতিল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১৪৭)

৪. নবুয়তের পর ভাষার পাঠ: অবশেষে মহান আল্লাহ্ তাঁকে মহাগ্রন্থ কোরআন দান করেন। যার ভাষা ও ভাষাশৈলী এক জীবন্ত অলৌকিকত্ব। আরবি ভাষায় এর সমকক্ষ কোনো গ্রন্থ এখনো রচিত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও রচিত হবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, মহানবি (সা.) কোরআনের ভাষা দ্বারা উপকৃত ও প্রভাবিত হয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ (সূরা আর রহমান, আয়াত ১ আল্লাহ্ সবাইকে বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী করুন। আমিন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *