অনলাইন ডেস্ক: চলতি বছরের চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডিশ বিজ্ঞানী স্ভান্তে প্যাবো। প্রাচীনকালে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া হোমিনিনদের দুটি প্রজাতির জিনগত বৈশিষ্ট্য উদঘাটন তথা মানব বিবর্তন নিয়ে গবেষণার জন্য এ পুরস্কার পেলেন তিনি।
গত সোমবার সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নোবেল কমিটি এ পুরস্কার ঘোষণা করে।
শারীরতত্ত্ব বা চিকিৎসায় নোবেল কমিটির সেক্রেটারি টমাস পার্লম্যান স্ভান্তে প্যাবোর নাম ঘোষণা করার পর হলঘরে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। পুরস্কারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে পার্লম্যান বলেন, ‘স্ভান্তে প্যাবো যা অর্জন করেছেন, তা কেউই ভাবতে পারেনি। সে অর্জন হলো এখনকার মানুষের বিলুপ্ত পূর্বপুরুষ নিয়ান্ডারথালদের জিনগত ম্যাপিং। ’
স্ভান্তে প্যাবোর কাজের মূল অংশ ছিল হোমিনিনদের নিয়ে। হোমিনিন একটি আদিম প্রজাতি, যারা মানব হিসেবে বিবেচিত হয়। হোমিনিন বলতে মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ বা মানুষের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত প্রজাতিগুলোকে বোঝায়।
নোবেল কমিটি জানায়, প্যাবোর কাজ কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পেতে সাহায্য করেছে। যেমন, আমরা কোন প্রজাতি থেকে এসেছি, আর আমাদের আগের প্রজাতির সঙ্গেই বা আমরা কিভাবে সম্পর্কিত? অন্যান্য হোমিনিন থেকে আমরা হোমো স্যাপিয়েন্স তথা আধুনিক মানুষরা কিভাবে আলাদা? অর্থাৎ প্যাবোর গবেষণা মানব বিবর্তনের ইতিহাসে নতুন দিশা দিয়েছে।
১৯৯০-এর দশকে মানুষের জেনেটিক রহস্য উদঘাটনের গবেষণা গতি পেয়েছিল। তবে সে সময় নির্ভর করা হতো আদিম ডিএনএর তাজা নমুনার ওপর। প্যাবোর আগ্রহ ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন, জরাজীর্ণ জিনগত উপাদানের প্রতি। অনেকে ভেবেছিলেন এটি অসম্ভব।
২০০৮ সালে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় ৪০ হাজার বছরের পুরনো আঙুলের হাড় খুঁজে পান। প্যাবো প্রথমবার এই ডিএনএর একটি জিনগত বৈশিষ্ট্য উদঘাটন করতে সক্ষম হন। দেখা যায়, হোমিনিন প্রজাতির এই ডিএনএ সম্পর্কে আগে আমাদের ধারণা ছিল না। যে প্রজাতির নাম ডেনিসোভান।
প্যাবোর গবেষণা দেখায় যে হোমো স্যাপিয়েন্সরা ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ার সময় ইউরেশিয়ায় আগে থেকেই নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানরা বাস করত। হোমো স্যাপিয়েন্সরা পরে নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছিল।
প্যাবোর গবেষণায় দেখা যায়, এখনকার ১ থেকে ৪ শতাংশ মানুষের ডিএনএ নিয়ান্ডারথালদের থেকে এসেছে। কোনো সংক্রমণ প্রতিরোধে মানুষের শরীরের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এই ডিএনএ।
আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে ৬ শতাংশ পর্যন্ত মানুষের ডিএনএ ডেনিসোভানদের। এই জিনের উত্তরাধিকারীদের শরীর কম অক্সিজেনেও খাপ খাইয়ে নেয় এবং বিশ্বের অতি উঁচু অঞ্চলে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। বর্তমান তিব্বতিদের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
স্ভান্তে প্যাবো ১৯৫৫ সালে স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৬ সালে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। এরপর জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (বার্কলেতে) পোস্ট ডক্টরাল সম্পন্ন করেন। ১৯৯০ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন। প্যাবো ১৯৯৯ সালে ‘বিবর্তনমূলক নৃবিজ্ঞান’-এর জন্য ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ২০২০ সাল থেকে জাপানের ওকিনাওয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। প্যাবোর বাবা সুনে বার্গসনট্রমও ১৯৮২ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বিজয়ীর প্রতিক্রিয়া
টমাস পার্লম্যানের কাছে টেলিফোনে নোবেল জয়ের খবর পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন প্যাবো। উচ্ছ্বসিত প্যাবো পার্লম্যানের কাছে জানতে চান, তিনি স্ত্রীকে খবরটা জানাতে পারবেন কি না। প্যাবোকে তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান পার্লম্যান।
নোবেল পুরস্কার কিভাবে তাঁর অব্যাহত কাজকে প্রভাবিত করতে পারে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের প্যাবো বলেন, ‘আশা করি এটি কোনো কিছুকেই খুব বেশি প্রভাবিত করবে না। ’ মজা করে তিনি যোগ করেন, ‘আশা করি, আমরা নীরবে কাজ চালিয়ে যেতে পারব এবং সাংবাদিকদের দ্বারা খুব বেশি বিরক্ত হব না। ’
প্যাবো আরো বলেন, ‘আমরা খুব ভাগ্যবান যে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পেরেছি। সতীর্থদের কাছ থেকে আমরা অনেক সমর্থন পেয়েছি। নিয়ান্ডারথালদের জেনেটিক ম্যাপিং করা সহজ নয়। ’
নিজের গবেষণার তাৎপর্য সম্পর্কে প্যাবো বলেন, ‘আমার জন্য সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল সময়ের পেছনে ফিরে যাওয়া এবং বিবর্তনের বিকাশকে পদে পদে অনুসরণ করার একটি সুযোগ। এমন সুযোগ আর কারো ভাগ্যে জোটে কি না সন্দেহ। ’