(বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ডাকাতি নিয়ে নির্মিত ‘বিলিয়ন ডলার হেইস্ট’ ডকুমেন্টারি অবলম্বনে লিখিত)
পার্ট-২
নিজস্ব সংবাদদাতা: ৬ ফেব্রæয়ারির সকালে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন জানতে পারল, চারটা ট্রাঞ্জেকশনের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের একটা ব্যাংকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আরো প্রায় ৯০ কোটি ডলার লেনদেনের জন্য অনুরোধ পাঠানো হয়েছিল, তারা ভয় পেয়ে যান। অভূতপূর্ব এই ঘটনায় কি করতে হবে তারা বুঝতে পারছিলেন না, একেবারে কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থা। তারা নিউইয়র্কে অবস্থিত মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাদের জরুরি কলের জবাব দিলো এনসারিং মেশিন। কারণ সেদিন ছিল শনিবার, ফোন ধরার মতো কেউই অফিসে ছিলেন না। একটা হযবরল অবস্থা, দুই প্রান্তেই। ফেডারেল রিজার্ভ প্রায় পুরোপুরি সুইফট ব্যাংকিং সিস্টেম নির্ভর। যেহেতু এর আগে কখনো সুইফট ব্যাংকিং সিস্টেমে এমন হ্যাকিং এর মতো ঘটনা ঘটেনি, ফেডারেল রিজার্ভ কখনোই ২৪ ঘন্টার হটলাইন চালু করেনি। অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকজন সুইফটের একজনের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়, উক্ত ব্যক্তি পরবর্তী নির্দেশনা দেওয়া পর্যন্ত সুইফটের সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে না পেরে সেই নির্দেশনাও পালন করেনি, তারা ভেবেছিল, কোথাও একটা ভুল হয়েছে, যেটাকে সহজেই সংশোধন করা যাবে। রবিবারে ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ কাগজপত্র পর্যালোচনা করে যখন বুঝতে পারলেন, টাকাটা আসলেই ম্যানিলার একটা ব্যাংকে চলে গেছে, তাদের হাতে করার বিশেষ কিছুই ছিল না। ফেডারেল রিজার্ভ তখনো বন্ধ। তারা ম্যানিলার ব্যাংকে জরুরি বার্তা পাঠালেন, এই অর্থ যেন লেনদেন না করা হয়, এটা চুরি করা টাকা, কোনোভাবেই যেন এই টাকা তুলতে দেওয়া না হয়। কিন্তু ম্যানিলায় তখন চীনা নববর্ষের ছুটি চলছে, রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক ছুটি। চোরেরা চুরি করার জন্য সময়টা এমনভাবে বেছে নিয়েছিল যাতে শুক্র থেকে সোমবার পর্যন্ত একটা লম্বা ছুটি তারা পেয়ে যায়। শুক্রবার বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি, শনি ও রবিবার নিউইয়র্কে সবকিছু বন্ধ, সোমবার ফিলিপাইনে চীনা নববর্ষের ছুটি। সব মিলিয়ে ডাকাতিটা সম্পন্ন করার জন্য তারা চার দিন সময় পেয়ে যায়। এটা ছিল খুবই একটা বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা, বলা যায় অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে হ্যাকিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বৈশ্বিক ব্যাংকিং সিস্টেম কতটা ভঙ্গুর আর ঝুঁকির মধ্যে আছে। ব্যাংক কখনো একা কাজ করতে পারে না, এটা একটা বৃহৎ সিস্টেমের অংশ। আর এই সিস্টেম বর্তমানে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন সেন্ট্রাল ব্যাংকের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার জমা রাখে। এর কম্পিউটার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সর্বাধুনিক, এই সিস্টেম হ্যাক করা প্রায় অসম্ভব। হ্যাকাররা জানত, তারা ফেডারেল রিজার্ভের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু তারা দেখল, ফেডারেল রিজার্ভ নিয়মিত বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। আর সেখানেই তারা একটা ফোঁকড় খুঁজে পেল।
হ্যাকাররা ব্যাংকগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিলো। ফেডারেল রিজার্ভ প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে হাজার হাজার লেনদেনের অনুরোধ করে থাকে। ফেডারেল রিজার্ভ লেনদেনের তথ্য পাঠাতে প্রায় পুরোপুরি সুইফট ব্যাংকিং সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল। সুইফট সারা বিশ্বে হাজার হাজার ব্যাংকের মাঝে টাকা লেনদেন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে লেনদেনের প্রধান মাধ্যম এই সুইফট। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকেই হোক, সুইফটের মাধ্যমে বিশ্বের অন্য প্রান্তের যে কোনো ব্যাংকে মুহূর্তেই টাকা পাঠানো যায়। সারা দুনিয়ার পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটা পরস্পর সংযুক্ত একটা একক ব্যবস্থার মতো কাজ করে, যেটা আন্তর্জাতিক লেনদেন চালু রাখার জন্য সুইফটের উপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, পুরো ব্যবস্থাটাকে ধ্বসিয়ে দেওয়ার জন্য একটা দুর্বল লিংকই যথেষ্ট।
যদিও ফেডারেল রিজার্ভই ছিল হ্যাকারদের টার্গেট, ফেডারেল রিজার্ভে ভালো পরিমাণ অর্থ জমা আছে, এমন একটা ব্যাংক তারা খুঁজ ছিল, যেটা নিউইয়র্ক থেকে অনেক দূরে ভিন্ন টাইম জোনে অবস্থিত আর তাদের কম্পিউটার ব্যবস্থার সিকিউরিটিতে ত্রæটি রয়েছে। হ্যাকাররা যারা এই ডাকাতির সাথে জড়িত, তাদের প্রধান টার্গেটই ছিল সুইফট ব্যাংকিং ব্যবস্থা, তারা শুধু কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাক করে কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢুকতেই দক্ষ ছিল না, তারা সুইফট ব্যবস্থাকেও খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। ফেব্রæয়ারির ৫ তারিখ যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীরা দেখলেন, সুইফট প্রিন্টার কাজ করছে না, তার বহু আগে থেকেই হ্যাকাররা কাজ শুরু করেছিল। আসলে এই হ্যাকিং বা আক্রমণ এক বছর পূর্বেই শুরু হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া এক রাতে বা এক মাস বা দুই মাস আগে ঘটেনি, দীর্ঘসময়ের পরিকল্পনা ও পদ্ধতিগত ধাপের মধ্য দিয়ে সবকিছু হয়েছে, কারণ হ্যাকারদের জন্য এটি একটা ব্যবসার মতো, যেটা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হয়।
ব্যাংক লুটের ঘটনা আগে বাস্তব দুনিয়ায় ঘটত, কিন্তু বর্তমানে এটা ঘটে অনলাইন জগতে। একজন চোর যদি ১০ কোটি ব্যাংক নোট চুরি/ডাকাতি করতে চায়, তাকে হয়ত ১০টা ট্রাকে নোটগুলো ভর্তি করতে হবে, সেই ট্রাকগুলো চালিয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে কেউ না কেউ দেখে ফেলতে পারে। কিন্তু কেউ যদি এই পরিমাণ মুদ্রা অনলাইনে সরায়, কেউ টেরও পাবে না। বিভিন্ন মুভিতে যেমন দেখা যায়, ব্যাংক হলিডেতেই চুরির ঘটনা ঘটে, এক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছিল।