সাম্পতিক সময়ে বিদেশি সাহায্যের উপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যের আন্তঃপ্রবাহ ছিল দেশের জাতীয় আয়ের প্রায় ৮ শতাংশ। তবে গত ২০১৫ হতে ২০২০ সময়কালে বার্ষিক এই হার নেমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ শতাংশে। বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বাংলাদেশ তার দাতাসদস্য ও বন্ধুপ্রতিম দেশগুলির অবদান কখনো ভুলতে পারে না। আমাদের মনে রাখা উচিত-১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে, তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ছিল চ্যালেঞ্জস্বরূপ। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চরম বিপদ ও সংকটকালে বাংলাদেশের পার্শ্বে এসে দাঁড়ায়। সেই সময় এই অর্থসহায়তাই হয়ে উঠেছিল সরকারের পুনর্গঠন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রধান হাতিয়ার। এমনকি দেশের প্রথম বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৭৫ শতাংশই সাজানো হয়েছিল বিদেশি অনুদান ও সাহায্যের উপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশ আজ যখন স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয় লাভের ৫৩তম বর্ষ উদ্যাপন করল, তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে কারা কারা অবদান রেখেছিলেন, তা একটু পিছন ফিরে দেখা আবশ্যক। এতে বন্ধু দেশগুলি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের বিরোধিতা করলেও অর্থসহায়তায় তারা পালন করেন অগ্রণী ভ‚মিকা। এর ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। গত করোনা মহামারির সময় তাদের সার্বিক সহায়তা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অর্থসহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবদান অবিস্মরণীয়। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের অবদান সবচাইতে অধিক ও অনন্য। শুরুর দিকেও ছিল এর প্রতিফলন।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস হতে সংকলিত তথ্যে দেখা যায়, ১৯৭২ সালের জুন মাস পর্যন্ত স্বাধীনতার প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন দেশ হতে প্রায় ৬৯৭ মিলিয়ন তথা ৬৯ কোটি ৭০ লক্ষ ডলারের ত্রাণ-অনুদান ও ঋণসহায়তা লাভ করে বাংলাদেশ। তার মধ্যে মিত্রশক্তি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগো¯øাভিয়া অর্থসহায়তা করে যথাক্রমে ২১৭, ৫২ এবং ৭ মিলিয়ন ডলার; মোট ২৭৬ মিলিয়ন ডলার। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেন, নরওয়ে, জাপান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের অবদান ছিল যথাক্রমে ২১৬, ৪৫, ২৭, ১২, ১১, ৯ এবং ৪ মিলিয়ন ডলার; মোট ৩২৪ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যদাতা প্রধান দেশগুলির অধিকাংশই এখন একটি কনসোর্টিয়ামের সদস্য। এইড কনসোর্টিয়াম যাহা দাতাগোষ্ঠী (এইড গ্রুপ) নামে পরিচিত। এর সদস্যরা পশ্চিমা বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরে রহেছে চীন, ভারত, কুয়েত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক ও ওপেক। তবে দাতাদের মধ্যে এখন শীর্ষস্থানীয় হচ্ছে জাপান। এরপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের নাম। সবচাইতে বড় পক্ষ বিশ্বব্যাংক গ্রুপ (৭০ শতাংশ), অন্য পক্ষগুলি হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাতিসংঘ। বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক উেসর অংশ যথাক্রমে ৬২ ও ২৩ শতাংশ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের বিরোধিতা করলেও আমেরিকার নাগরিকগণ বরাবরই ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে। আমেরিকার কেনেডি পরিবার, সংগীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অবদান ভুলার নহে। একই কারণে চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ যেখানে দীর্ঘ সময় নেয়, সেখানে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই আমেরিকা বাংলাদেশের সহিত ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির দুই প্রাণভোমরা পোশাকশিল্প ও প্রবাসী আয়ের সিংহভাগ ও উল্লেখযোগ্য অংশ আসে পশ্চিমা বিশ্ব হতে। অতএব, আমাদের আচার-আচরণ ও কথাবার্তা এমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে তাদের সম্পর্কে কোনো ভুল, অসংলগ্ন ও অহিতকর কোনো বার্তা না যায়।