পারস্যের জন্মান্ধ কবি রুদাকি

পারস্যের জন্মান্ধ কবি রুদাকি

মোস্তাক আহমাদ দীন: রাজধানী বুখারা ছেড়ে অপরূপ মনোরম স্থান হেরাতে সাময়িক অবকাশ যাপন করতে গিয়ে সামানি শাসক নসর বিন আহমদ (শাসনকাল: ৯১৪-৯৪৩ খ্রি.) যখন দীর্ঘদিন ধরে আর ফিরছিলেন না, তখন তাঁর বন্ধু ও পার্ষদেরা রুদাকিকে গিয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘আপনি যদি সম্রাটকে বুখারায় ফিরিয়ে আনতে পারেন, তাহলে আপনাকে আমরা পাঁচ হাজার আশরফি উপহার দেব।’ আবু আবদুল্লাহ জাফর ইবনে মুহাম্মদ আল রুদাকি ছিলেন সামানি সম্রাটের সভাকবি। তিনি সেই অধিকারে হেরাতে হাজির হয়ে শুনলেন, নসর বিন আহমদ সুরা পান করছেন। রুদাকি তাঁর প্রিয় বাদ্যযন্ত্র চঙ্গ বাজিয়ে সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন স্বরচিত গজল, যার অর্থএমন:
‘বাতাস বইছে মুলিয়ান নদীটিকে ছুঁয়ে
আমি তার সুগন্ধ পাচ্ছি
সে বাতাস নিয়ে আসছে অপেক্ষমাণ কত বন্ধুর খবর
আমু দরিয়ার এবড়ো খেবড়ো জমিন
আর তার খরখরে বালুতীর
আমার পায়ে রেশমের মতো লাগছে
আমার ঘোড়াটিকে স্পর্শ করছে
জয়হুন নদীর পানির উচ্ছাস
হে বুখারা, বাদশাহ আজ তোমার মেহমান
আজ তুমি আনন্দ করো
বুখারা যেন সেই সুন্দর বাগান,
বাদশাহ যার কাঙ্খিত গাছ
আজ গাছ সেই বাগানের দিকেই যাচ্ছে
বুখারা যেন সেই আকাশ, বাদশাহ যার কাঙিক্ষত চাঁদ
চাঁদ আজ আকাশের আরাধ্য মেহমান।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ভাবের সমন্বয়ে তৈরি এই গজলের বাণী ও সুর নাকি সম্রাটের ওপর এমনই প্রভাব বিস্তার করল যে বলা হয়, তিনি জুতা না পরেই-মতান্তরে মোজা না পরেই বুখারার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন।
বুখারায় রয়ে যাওয়া সম্রাটের জন্য বিপুল আগ্রহে অপেক্ষমাণ বন্ধু আর পার্ষদেরা রুদাকিকে প্রতিশ্রুত পাঁচ হাজার আশরফি দিয়েছিলেন ঠিকই, এ ছাড়া সম্রাট নসর বিন আহমদও তাঁকে পুরস্কৃত করেছিলেন। আন্দাজ করি, কবিকে পুরস্কৃত করার কারণ ছিল দুটি। প্রথমত, রুদাকি ছিলেন অন্ধ, অনেকের মতে গ্রিক কবি হোমারের মতোই জন্মান্ধ, (এ নিয়ে অবশ্য গবেষকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে) আর তিনিই কিনা কোনো দিন বুখারাকে না দেখে, শুধু শুনে, কল্পনার আশ্রয়ে, আশ্চর্য একটি গজল লিখলেন! অন্য কারণটি হলো, সম্রাটের মতি পরিবর্তন। কেননা, এ কথা কে না জানে যে সম্রাট রাজাসন ছেড়ে দীর্ঘদিন অন্যত্র ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে থাকলে রাজ্যের কতটা ক্ষতি হয়!
সম্রাটকে উদ্দেশ করে লেখা রুদাকির এই কবিতাকে আমরা এখানে ‘গজল’ বলছি বটে, কিন্তু সেই সময়কার বিচারে, বিষয়গত কারণে, একে ‘কসিদা’ও বলা যায়। তবু এটি যেহেতু অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত, তাই সেই কথা মাথায় রেখে, বিষয়-অনুষঙ্গের কারণে একে গজল বলাই সংগত। পরবর্তীকালে নানা ভাবের শের অন্তর্ভুক্ত করে উত্তরসূরি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি অসাধারণ সব গজল লিখবেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর বহুল পরিচিত একটি গজলে আমরা রুদাকির সরাসরি প্রভাব পাবই। তাছাড়া আরও বহু গজলেও দেখতে পাব রুদাকির গজলের বিষয়-অনুষঙ্গের প্রতিধ্বনি। উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত সমালোচক আল্লামা শিবলি নোমানি অবশ্য তাঁর শের-উল-আজম গ্রন্থে কেবল হাফিজের ওপর নয়, ওমর খৈয়ামের একাধিক কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে রুদাকির প্রভাবের কথা বলেছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন রুদাকির সেই সব গজলের কথা, যেখানে তিনি দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্বের উল্লেখ করে সানন্দ জীবনযাপনের কথা বলেছেন। পরবর্তীকালের কবিদের ওপর দীর্ঘকালব্যাপী প্রভাব এবং তাঁর সময়ে আরবি ভাষার ব্যাপক প্রভাব থাকা সত্তে¡ও মাতৃভাষার ঐতিহ্য অবলম্বন করে তার পরিসর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য রুদাকিকে পারস্য সাহিত্যের জনকের মর্যাদা দেওয়া হয়।
এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার যে রুদাকি শুধু গজল লেখেননি, লিখেছিলেন কাসিদা, মর্সিয়া রুবাই মসনবিসহ অসংখ্য খণ্ডকবিতা; এবং বলা হয় যে প্রচলিত সব আঙ্গিকের কবিতা রচনায়ই তিনি ছিলেন দক্ষ। কসিদার জন্ম আরবে কিন্তু ফারসি সাহিত্যে কসিদার শুরুয়াত রুদাকির মাধ্যমেই। এক্ষেত্রে তিনি পূর্বচলিত প্রথাগত ধারা অবলম্বন করলেও এতে প্রাকৃতিক প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ ব্যবহার করে নতুনত্ব এনেছিলেন।
প্রচলিত সব রকম আঙ্গিকে কবিতা রচনার পাশাপাশি আরবি ভাষা থেকে ‘কালিলা ও দিমনা’ বইটি অনুবাদ করেন রুদাকি। বলা ভালো, বিখ্যাত এই বই সংস্কৃত ভাষায় লেখা পঞ্চতন্ত্র-এর ‘করটক ও দমনক’ থেকে ইংরেজি ও আরবি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। পরে এটি আরবি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন গোলাম সামদানী কোরায়শী।
খ্রিষ্টীয় নবম শতকের শেষার্ধে আনুমানিক ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান তাজিকিস্তানে জন্ম নেওয়া রুদাকি সম্পর্কে সমালোচকদের মত, তিনি লাখো কবিতার রচয়িতা। সমালোচক রশিদ সমরকন্দী তাঁর মজমা আল ফসাহা বইয়ে লিখেছেন, তিনি ১৩ বার গুনে দেখেছেন রুদাকির কবিতার সংখ্যা এক লাখ। তাঁর ধারণা, সময় নিয়ে আরও সূক্ষ্মভাবে গণনা করলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।
রুদাকি লাখো কবিতা লিখুন আর হাজার কবিতা লিখুন, সেই ভান্ডার থেকে অল্পসংখ্যক কবিতা সংকলিত হয়ে পরবর্তী সময়ের পাঠকের কাছে পৌঁছেছে। জানতে পারি, তিনি মসনবিও লিখেছেন, কিন্তু তাঁর একটি মসনবিরও খোঁজ পাওয়া যায় না। দুঃখের বিষয়, অল্প কটি গজলসহ রুবাই, কাসিদা মিলে এক হাজার শ্লোকও সংকলিত হয়নি এই কবির। ফলে রুদাকির রচনা সম্পর্কে কিছুটা ব্যঙ্গার্থে কথিত আছে:
‘আজ উন চনদেঁ নাইম জাওদানি
ক্যা মানদ্ আজ আল সাসান ওয়া আল সামান
ছানাএ রুদাকি মানদ আছ্ত ওয়া মাদ হাশ
নাওয়ামে বারবাদ মানদ আছত দোসতান।’
অর্থাৎ সাসানি ও সামানি বংশের তারিফ করে লেখা কবিতা আর বারবাদকে নিয়ে লেখা সংগীত ও কাহিনিগুলোই শুধু রক্ষা পেয়েছে।
এর বাইরে গজলের বাণীতে রুদাকির যে জীবনবোধের পরিচয় খুঁজে পাই, তা কি তাঁর বিপুল রচনা ও জীবনতথ্য সংগ্রহে অনীহা তৈরির পেছনে ভূমিকা রেখেছে? কথাটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে এখানে রুদাকির একটি গজল পড়ে দেখা যেতে পারে:
‘য়ার মন গুফতা বেহেশত আছত আমে শগফত, আয়ান বাগ নিছ্ত
গুফতম আয়ান বাগ্ই খরমম চোন বেহেশত কর দেগার
আন বেহেশত সা পদিদ আছত আয়ান উছতে এয়ান
আয়ান বা নকদে আছত আন বা বা নছিহ আন নেহা, আয়ান আশকার।’
অর্থাৎ, আমার প্রিয়তমা বলল, এ এক সুন্দর বাগান বটে কিন্তু তা তো এই দুনিয়ারই সৃষ্টি, বেহেশতের নয়। আমি বললাম, এই বাগান বেহেশতের মতোই অপরূপ ও মনোরম। এ ছাড়া সেই বেহেশতের বাগান তো অগোচর, আর এটি একেবারে চোখের সামনে বাস্তব।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশের সুফি ও বাউল-ফকিরদের গানে ধর্মের বাহ্য আচারের প্রতি যে মনোভাব লক্ষ্য করা যায়, তার পরিচয় রয়েছে রুদাকির কবিতায়। বাউলদের দেহতত্ত¡ মূলক গানে নশ্বর পৃথিবীতে আসা মানুষের দেহের যে অন্তিম পরিণতি, রুদাকির একটি গজলে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কেবল পার্থক্য হলো, দেহতত্ত¡মূলক গানের যে অনিবার্য পরমমুখিতা, তা সেই গজলে নেই; এখানে আছে আর্থিক অনটনের ভয়াবহতা আর ভিক্ষা উপকরণের জন্য প্রার্থনা। এর কারণ, তাঁর বাস্তব জীবনে শেষমেশ তা-ই ঘটেছিল।
সামানি শাসন শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত রুদাকিকে বুখারা থেকে পালিয়ে যেতে হয় এবং চরম অনটনের মধ্য দিয়ে আনুমানিক ৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *