মৃত আত্মা সজীব করে সিয়াম সাধনা
মাহে রমজানের ফজিলত আলোচনা করতে গিয়ে হযরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘রমজানের তিন দশকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তিন ধরনের বৃষ্টি ঝরে। প্রথম দশকে ঝরে রহমতের বৃষ্টি। দ্বিতীয় দশকে মাগফিরাত এবং তৃতীয় দশকে মুক্তি। প্রথম ১০ দিন ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর রহমতে সিক্ত হবে। দ্বিতীয় দশকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। আর তৃতীয় দশক তথা শেষ দশকে বান্দা কান্নাকাটি এবং ইতিকাফের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে নাজাত-মুক্তি নিশ্চিত করবে।’
রহমত ও মাগফিরাতের বৃষ্টি পার করে এখন আমরা ভিজছি নাজাতের বৃষ্টিতে। দুনিয়াজুড়ে আরশের মালিক নাজাত বর্ষণ করছেন। ভাগ্যবান বান্দা সে, যে প্রভুর নাজাত ধারণ করতে পারল। আর যে অবহেলা-অযত্নে প্রভুর নাজাত থেকে দূরে থেকেছে, তার ব্যাপারে আমরা আর কী বলব, নবিজি নিজেই বলেছেন-এমন হতভাগ্য বান্দা আরশের নিচে, জমিনের ওপরে আর কেউ নেই।
বৃষ্টি যখন হয়, তখন সব জায়গায়ই বৃষ্টি ঝরে। কিন্তু সব ভ‚মি বৃষ্টির পানি ধারণ করে না। যে ভ‚মিটা উঁচু, বাঁকা, সেখানে বৃষ্টি ঝরলেও পানি জমে না। তেমনই নাজাতের বৃষ্টি সব বান্দার ওপর সমানভাবে ঝরছে, ঝরবে। কিন্তু যে বান্দার কলবের জমিনটা অহংকারে উঁচু হয়ে আছে, নাফরমানিতে বেঁকে গেছে, সে বান্দা নাজাত ধারণ করার যোগ্যতা রাখে না। কারণ, অহংকারীকে আল্লাহ পাক যতটা অপছন্দ করেন, আর কাউকে এত বেশি অপছন্দ করেন না।
সিয়াম সাধনা হলো উঁচু কলবকে নিচু বানানোর মাস। অহংকারী মনকে বিনয়ী করার মাস। বান্দা যখন সিয়াম সাধনা শুরু করে, আস্তে আস্তে মসজিদের সঙ্গে, কুরআনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে, তখন অটোমেটিকভাবে হৃদয় নরম হয়ে আসবে। চোখ ভিজে উঠবে। দুনিয়ার মোহ তুচ্ছ মনে হবে। কবরের জীবনের জন্য এক ধরনের পেরেশানি, টান অনুভব হবে। কিন্তু শুরুটা আপনাকেই করতে হবে। অনেক মানুষ মনে করে, কোনো এক অলৌকিক শক্তি তাকে হঠাৎ ভেতরে-বাইরে বদলে দেবে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বান্দা যদি নিজেকে বদলানোর জন্য প্রস্তুত না করে, নিজের ভেতরে যদি নাজাত ধারনের জন্য বিনয়ী না হয়, তাহলে আল্লাহ নিজ থেকে কাউকে পরিবর্তন করেন না। পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ জালেমদের হেদায়াত করেন না, পথ দেখান না।’
বছরের অন্য মাসে যে সুযোগটা থাকে না, রমজানে সেই সুযোগ আমরা পেয়ে যাই। রমজানজুড়ে সব জায়গায় এক ধরনের ধর্মীয় আবহাওয়া পাওয়া যায়। কেউ চাইলে এই সময়ে খুব সহজেই নিজেকে বদলে নিতে পারে। খারাপ অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। অহংকারে উঁচু মনটাকে বিনয়ে গলিয়ে নেওয়ার সুযোগ রমজান ছাড়া আর অন্য কোনো মাসে এত সুন্দর, এত চমৎকারভাবে ধরা দেয় না। রমজান পেয়েও যারা প্রভুর সামনে দাঁড়ায় না, নিজেকে প্রভুর কাছে সমর্পণ করে না, তাদের চেয়ে হতভাগা আর কে আছে? রমজানের বৃষ্টিতে যে ভিজল না, নাজাতের প্রতিটি ফোঁটা যে যতেœর সঙ্গে আগলে রাখে না, তার চেয়ে পোড়া কপাল আর কে আছে?
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘বাবা-মা যেমন ডানপিটে সন্তানের জন্য পেরেশান থাকে, আমি আল্লাহও গোনাহগার বান্দার জন্য আরও বেশি পেরেশান থাকি। অপেক্ষায় থাকি, একদিন না একদিন সে প্রভুকে চিনবেই। প্রভুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বেই। যখন সে অল্প অল্প আমাকে চিনতে শুরু করে, আমি তার কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেই। সে যখন প্রভুর ভাবনায় মন ঘুরায়, আমি তখন দুহাত বাড়ি তার অপেক্ষায় থাকি। সে আমার দিকে হাঁটা শুরু করলে আমি তার দিকে দৌড়ে আসি।’ সত্যিই তো! এমন মায়াভরা আল্লাহকে ভুলে, তার নাজাতে না ভিজে যে বান্দা কবরে যায়, তার চেয়ে পোড়া কপাল আর কেউ হয় না। হে ভাই! আসুন! প্রভুর পায়ে লুটে পড়ি। নাজাতের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে জান্নাতের পথে এগিয়ে চলি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে নাজাতের বর্ষণে সিক্ত হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।