জলবায়ু পরিবর্তন: ভয়াবহতার সম্মুখীন বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তন: ভয়াবহতার সম্মুখীন বাংলাদেশ

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ৭ম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশের ৬৪ জেলার অর্ধেকই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহতার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। উপকূলীয় এলাকায় বসতভিটা হারানো মানুষ শহরাঞ্চলে চলে আসছে। এতে মানুষের অত্যধিক চাপে শহরগুলো ‘হিট আইল্যান্ডে’ পরিণত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও হাওর এলাকায়ও ঝুঁকি বেড়েছে।


বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি ক্রমেই বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং ঝড়বন্যা বাড়ায় বসতভিটা হারাচ্ছে মানুষ। ২০১৪ থেকে ২০২০- এ সাত বছরে ৫৮ জেলায় জলবায়ুসংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্যোগে অন্তত ১ হাজার ৫৩ জনের প্রাণহানি ও ৯৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দেশে কর্মরত ৪৫টি এনজিওর নেটওয়ার্ক স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশের (এসএফবি) এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ সময়ের সব বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের চারটি অঞ্চল বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। এগুলো হলো বরেন্দ্র, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূল ও হাওর এলাকা। জেলা হিসেবে ময়মনসিংহের পশ্চিমাংশ, রংপুরের পূর্বাংশ, খুলনার দক্ষিণাংশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।


শহর পরিণত হচ্ছে ‘হিট আইল্যান্ডে’: এ বছর বর্ষার শুরুতে সেভাবে বৃষ্টিপাতের দেখা মেলেনি। তাপমাত্রাও ছিল বেশি। এর আগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বয়ে যায় তীব্র তাপপ্রবাহ। জুলাইতে ভরা বর্ষা থাকার কথা, সেখানে এবারের জুলাইতে বৃষ্টিপাত সেভাবে হয়নি। এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয়, জুলাইতে এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে গরম দিনের রেকর্ড করা হয়েছে। এবার প্রথমবারের মতো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১৭ সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। ৬ জুলাই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক শূন্য ৮। বিশেষজ্ঞরা এ অবস্থার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। তারা বাংলাদেশে উষ্ণায়নের জন্য দায়ী করছেন পাশের দেশগুলোর নির্গত মাত্রাতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাসকে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে এখন থেকেই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে গ্রীষ্মকালে দেশের গড় তাপমাত্রা ৩ থকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন। বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তখন ৪৬ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশনের (সিইজিআইএস) হিসাবে ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সালে প্রতি বছর গড়ে দেশে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.০০৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বেড়েছে গড়ে ০.৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বেড়েছে গড়ে ১.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।


অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ছয় গবেষক ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট শহরের ওপর গবেষণা করে দেখেন, বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি যেখানে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রয়েছে, সেখানে ঢাকার তাপমাত্রা গত ২০ বছরে প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। গবেষণায় বলা হয়, ঢাকাসহ অন্য মহানগরগুলো পরিণত হচ্ছে ‘হিট আইল্যান্ড’ বা উত্তপ্ত দ্বীপে। এর আশপাশে তাপমাত্রা কম থাকলেও দ্বীপটি দিনরাতই উত্তপ্ত থাকছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূল ও বন্যাপ্রবণ এলাকা থেকে মানুষ শহরে চলে আসছে। এর ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোর তাপমাত্রা বেড়ে তা হিট আইল্যান্ডে পরিণত হচ্ছে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যখন আমরা দেখি দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন ধরে নিতে হবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হচ্ছে। সাধারণত কানাডার ভ্যানকুভারে তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ওঠে না। কিন্তু সম্প্রতি আমরা দেখেছি, গ্রীষ্মকালে সেখানে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠেছে। এবার দেশে যে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে তার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। এর সঙ্গে বেশি গাছ কাটা, নদী দখলের মতো মানবসৃষ্ট কারণও দায়ী।’


ঘূর্ণিঝড় নিয়েও শঙ্কা : প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় নিয়েও শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। দেশে আগামী বছরগুলোয় একাধিকবার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার শঙ্কা রয়েছে। এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন কিছুটা হলেও দায়ী বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। গত এক দশকের বেশি সময়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত (২০১৮ সাল বাদে) প্রতি বছরই বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালেই তিনবার ঘূর্ণিঝড় হয়। বিশ্বব্যাংকের ‘কান্ট্রি ক্লাইমেট ও ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে। যেভাবে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে তাতে এ ক্ষতি আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, কখনো কখনো ঘূর্ণিঝড়ের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা আরও বেড়ে যাওয়ার কথা।


বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা: চলতি শতকের শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের উপকূলীয় এলাকার ১২ দশমিক ৩৪ থেকে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ সাগরের পানিতে ডুবে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের গবেষণায় পাওয়া ফল থেকে জানা যায়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার প্রায় ৩ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।


জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো কোনো ঘটনা মানুষের অভ্যস্ততার বাইরে চলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বলতে সামগ্রিকভাবে জলবায়ুর যে চরম অবস্থা তাকে বোঝানো হয়। যখন জলবায়ু চরম আকার ধারণ করে বিশেষ করে তাপমাত্রা বেশি বৃদ্ধি পায় বা তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যায়, অতিরিক্ত আর্দ্রতা হয় সেই অবস্থার সঙ্গে মানুষ ততটা অভ্যস্ত নয়। আর মানুষ অভ্যস্ততার বাইরে চলে গেলে তা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও প্রভাবিত হয়।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *