দেওয়ানবাগ ডেস্ক: নিজের কোলেই ক্ষুধায় কাতর সন্তানের মৃত্যুর মতো হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হবেন জীবনে তা কখনো কল্পনাও করেননি ইয়াযান আল-কাফারনেহর মা। কিন্তু সেই ‘অভাবনীয়’ বিষয়টিই ঘটেছে। অনাহারে চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যুতে হতবাক এই মায়ের চোখের জল বাঁধ মানছিল না। দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরের এক হাসপাতালের মেঝেতেই বসে শোক করছিলেন তিনি।
ইয়াযান আল-কাফারনেহ একা নন, দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া গাজা উপত্যকায় আরো কিছু শিশু অহানারে মারা যাওয়ার কথা জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস। আরো অনেকে মৃত্যুর প্রহর গুনছে বলেই সাহায্য সংস্থাগুলোর ধারণা।
কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে গত সোমবার ইয়াযানের মা এক সাংবাদিককে বলেন, ‘আজ আমার ছেলেকে হারালাম। অপুষ্টির জন্য ১০ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিল ও।
ক্রমেই আমার ছেলের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। ওজন কমে ও কঙ্কালে পরিণত হয়েছিল।’
পরিবারটি জানায়, ১০ বছর বয়সী ইয়াযানের ওজন খুব বেশি কমে গিয়েছিল। তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার ছিল পুষ্টিকর খাবারের।
কিন্তু গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলা শুরু হলে প্রাণ বাঁচাতে উত্তর গাজা ছেড়ে দক্ষিণে যাওয়া শরণার্থী পরিবারটির তা জোগান দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। মারা যাওয়ার আগের ছবি ও ভিডিওতে হাসপাতালের বিছানায় কঙ্কালসার ইয়াযানকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগে শিশুটি বেশ স্বাস্থ্যবান ছিল। ছেলের সুস্থ সময়কার ভিডিও দেখিয়ে ইয়াযানের বাবা বলেন, ‘আজ খাবারের অভাবে আমার ছেলেকে হারাতে হলো।’ বিশ্ববাসীর প্রতি অনুরোধ রেখে ইয়াযানের মা বলেন, ‘গাজার শিশুদের দিকে তাকান। দেখুন কিভাবে তাদের জীবন বদলে গেছে।’
খাদ্যসংকটে মারা যাচ্ছে শিশুরা : জাতিসংঘের অধীন প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস নিজে উত্তর গাজায় ১০টি শিশুর মৃত্যুর কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, গত সপ্তাহান্তে ডাব্লিউএইচওর একটি দল উত্তর গাজার আল-আওয়াদা ও কামাল আদওয়ান হাসপাতালে গিয়ে সেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখেছে। গত বছরের অক্টোবরের গোড়ায় গাজায় সংঘাত শুরুর পর প্রথমবারের মতো সেখানে যাওয়ার সুযোগ পান জাতিসংঘের সংস্থাটির প্রতিনিধিরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে ডাব্লিউএইচও প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস উত্তর গাজার ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি’ নিয়ে সরব হয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘খাদ্যসংকটে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছে ১০ শিশু। দেখা দিয়েছে তীব্র মাত্রায় অপুষ্টি। পাশাপাশি ধ্বংস করা হয়েছে হাসপাতালের ভবনগুলো।’
হামাসের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত রবিবার জানায়, কামাল আদওয়ান হাসপাতালে অন্তত ১৫টি শিশু অপুষ্টি ও পানিশূন্যতায় মারা গেছে। ওই দিনই দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে আরেক শিশুর মৃত্যু হয় বলে ফিলিস্তিনের সরকারি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
গেব্রিয়েসাস জানান, উত্তর গাজায় তীব্র মাত্রায় অপুষ্টি দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি, খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতালের ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। উত্তর গাজায় রয়ে যাওয়া আনুমানিক তিন লাখ মানুষ সামান্য খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছে।
ডাব্লিউএইচওর প্রধান লিখেছেন, ‘ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকেই উত্তর গাজায় নিয়মিত প্রবেশের অনুমতির জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা করছিল ডাব্লিউএইচও। এত দিনে প্রথমবারের মতো সেখানে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে ইসরায়েল।’
গাজায় দুর্ভিক্ষ ‘প্রায় অনিবার্য’ বলে গত সপ্তাহেই সতর্ক করে দিয়েছিল জাতিসংঘ। বিশ্ব সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, গাজা উপত্যকার কমপক্ষে পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ (মোট জনসংখ্যার এক- চতুর্থাংশ) বিপর্যয়কর মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে। উত্তর গাজার দুই বছরের কম বয়সী প্রতি ছয়টি শিশুর মধ্যে একটি তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক অ্যাডেল খোডর গত রবিবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শিশুমৃত্যুর যে ভয়টা আমরা পেয়েছিলাম, সেটাই ঘটছে। অপুষ্টির কারণেও গাজা উপত্যকায় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। এই মর্মান্তিক ও করুণ মৃত্যুগুলো মানবসৃষ্ট, অনুমানযোগ্য এবং পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য।’
ইসরায়েলি বাধার মুখে ত্রাণ সরবরাহ : হামাসকে দমনের নামে বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েল ও মিসর ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত জনপদটির ওপর অবরোধ বজায় রেখেছে। এ কারণে ইসরায়েলি বাহিনীর এবারের সামরিক অভিযানের আগেও অবরুদ্ধ জনপদ গাজার জনগণ বেঁচে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। সেখানকার অন্তত ৬৩ শতাংশ বাসিন্দার কাছে খাবারসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা সরবরাহ করত আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো। গাজার প্রায় অর্ধেক মানুষই বেকার। অর্ধেকের বেশি মানুষ দরিদ্র। হামাসের ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে চালানো হামলার প্রতিশোধ নিতে দেশটির বাহিনী ৭ অক্টোবর থেকেই হামলা শুরু করে। তাত্ক্ষণিকভাবে পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গাজার বাসিন্দাদের ওপর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নেমে আসে। এর কিছুদিন পর অতি সীমিত মাত্রায় ত্রাণ সরবরাহ যেতে দেওয়া হয়। তবে উত্তর গাজায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কোনো সহায়তা সংস্থা ত্রাণ সরবরাহ করতে পারেনি বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী সেখানে সহায়তা নিয়ে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে।
বিমান থেকে কিছু সহায়তা: গাজায় সংঘাত শুরুর পর গত শনিবার প্রথমবারের মতো বিমান থেকে ত্রাণসামগ্রী ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, মিসর ও জর্দানও এভাবে সহায়তা ফেলে। তবে এসব সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল বলে জানিয়েছে সহায়তা সংস্থাগুলো। বলা হচ্ছে এভাবে সহায়তা দেওয়া হলে তা ঠিকমতো পৌঁছে না। বিষয়টি অনেক ব্যয়বহুলও। বিমান দিয়ে ত্রাণ সহায়তা বিতরণকে পরিস্থিতির ভয়াবহতার একটি সূচক হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
ত্রাণ সহায়তা ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর জন্য করুণ পরিণতিও বয়ে এনেছে। গত সপ্তাহেই ত্রাণ নিতে আসা ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ও পদদলিত হয়ে শতাধিক ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ একে ‘নির্বিচার গণহত্যা’ আখ্যা দিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, একদল লোক চেক পয়েন্টের সেনাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় তারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য গুলি করে।
গাজায় ত্রাণ দিতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছে কয়েকটি সাহায্য সংস্থা। গাজা উপত্যকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএনআরডাব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি গত সোমবার অভিযোগ করেন, ইসরায়েলি সরকার গাজায় তাদের উপস্থিতি ‘মুছে ফেলার’ চেষ্টা করছে।
ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্যানুসারে, গাজায় ২২ লাখের বেশি মানুষের বাস। জাতিসংঘ জানিয়েছে, যুদ্ধের প্রভাবে জনপদটির ৮৫ শতাংশ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ছিটমহলটির ৬০ শতাংশ অবকাঠামোই ধ্বংস হয়ে গেছে।