অর্থ ডেস্ক: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকটই পুরো অর্থনীতি কাবু করে ফেলেছে। বলা যায়, ঢাকাসহ সারা দেশে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। একদিকে অব্যাহত লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে কৃষি, শিল্পসহ সব ধরনের উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যদিও আশা করা হচ্ছে আসন্ন শীত মৌসুমে লোডশেডিং কিছুটা কমবে। কিন্তু শীতের সময় গ্যাসের চাপ এমনিতেই কম থাকে। এ বছর অনেক আগে থেকেই গ্যাসের সংকট চলছে। শিল্পসহ আবাসিক খাতেরও গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে না পারায় এমনিতেই তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রয়াদেশ কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনার পর হুন্ডির ব্যবহার বাড়ায় বৈধ পথে কমছে রেমিট্যান্স। কেননা হুন্ডিতে টাকা পাঠালে ব্যাংকের তুলনায় প্রবাসীরা বেশি লাভবান হচ্ছেন। এতেও রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি অনেক বেশি হওয়ায় ডলারের ঘাটতি থাকছে সব সময়। এতে ডলারের বাজারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখনো ব্যাংক ও খোলাবাজারের মধ্যে ডলারের দামে ফারাক অনেক। আমদানির লাগাম টেনেও বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমানো যাচ্ছে না। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতের অবস্থাও নাজুক। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে কাগজে কলমে রিজার্ভ নেমেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। তবে বাস্তবিক পক্ষে রিজার্ভের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন ডলারের মতো। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি গত ১১ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। এতে সামনের তিন থেকে ছয় মাস সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সময়টাকে মোকাবিলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সতর্কও করা হচ্ছে। বেশি চিন্তা ডলার ও খাদ্য সংকট নিয়ে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আসন্ন দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য সংকট নিয়ে বারবার সতর্ক করছেন দেশবাসীকে। এ ছাড়া জ্বালানি সংকট ভোগাচ্ছে শিল্প খাতকে। ব্যাহত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই বলছেন বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফও বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়েছে। ওয়াশিংটনে গতকাল শেষ হওয়া বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বার্ষিক সভায়ও দুর্ভিক্ষের বিষয়টিই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এজন্য বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশকে সতর্ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে সেসব দেশকে নিজেদের খাদ্য নিরপাত্তা নিশ্চিতের জন্য অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চলমান এ সংকট তীব্র হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। খাদ্য সংকট দেখা দিলে এর প্রভাব সবার আগে পড়বে গরিব দেশগুলোর ওপর। তবে আমদানিনির্ভর দেশগুলো এমনিতেই ডলার সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশেও এ সংকট চলমান। এ পরিস্থিতিতে আমাদের যেমন অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে, তেমনি খাদ্যের মজুদও বাড়ানো জরুরি।’
বিশ্বকে ২০২৩ সালের খাদ্য, জ্বালানি তেলসহ মহামন্দার বিষয়ে সতর্ক করছে বিশ্বব্যাংক। এবার এ মহামন্দা ঠেকাতে ও দুর্ভিক্ষ কাটাতে ১৭০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি। সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংক-প্রধান ও আইএমএফ এমডি। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বৈশ্বিক মন্দার কবলে পড়লে বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। তবে বিশ্বমন্দার আগেই বর্তমানে ৪৮টি দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ চরম খাদ্যসংকটে রয়েছে। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা মনে করেন প্রভাবশালী দেশ, অঞ্চলপ্রধান ও বিশ্বনেতাদের নির্লিপ্ততা বিশ্ববাসীকে মহাসংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক সংকটের জেরে বাংলাদেশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ১৫৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা, যা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং আগস্টের তুলনায় ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে। সরকারের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিতেও মন্থর গতি বিরাজ করছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আগাম কাটছাঁট শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকারের কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগীরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতিই সংকুচিত হচ্ছে। এশিয়ার অর্থনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়; যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও চলতি বছর শেষে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।