মুফতি মাহমুদ হাসান
পবিত্র কুরআন ওই মহান সৃষ্টিকর্তার বাণী, যিনি সব কিছু আপন কুদরতে সৃষ্টি করেছেন। যাঁর জ্ঞানের সীমার বাইরে কিছুই নেই। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব কিছুই যাঁর জ্ঞানের সামনে সমান। তাই তাঁর বাণীও সব যুগের জন্য সমভাবে গ্রহণীয় ও পালনীয়।
মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট পথে, এটা মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞানীর নির্ধারণ। আর চাঁদের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি মনজিল, অবশেষে সেটি খেজুরের শুষ্ক পুরনো শাখার মতো হয়ে যায়। সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকেই কক্ষপথে ভেসে বেড়ায়। ’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত ৩৮-৪০)
চন্দ্র-সূর্য যেরূপ পৃথিবীবাসীকে আলো, তাপ-উত্তাপ ও দিকনির্ণয়ের ন্যায় বৈষয়িক কাজে সেবা দিয়ে থাকে, তেমনি তা আল্লাহর বিধি-বিধান পালন তথা নামাজ-রোজা ও হজ-জাকাতের সময় নির্ধারণ, কিবলা নির্ণয় ইত্যাদির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদান করে। তাই চাঁদ-সুরুজের ব্যাপারে জ্ঞান রাখা আমাদের বৈষয়িক কাজগুলোর জন্য যেরূপ জরুরি, তদ্রুপ দ্বিনি বিষয়াদির জন্যও আবশ্যক।
দ্বিতীয় হিজরি শতাব্দী থেকেই মুসলমানদের মধ্যে এ বিষয়ের জ্ঞানচর্চা শুরু হয়। ধীরে ধীরে অনেক মুসলিম গবেষকরা গবেষণা করে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ পাণ্ডিত্য এমনকি বিশ্বময় নেতৃত্বের আসনে আসীন হন। পরবর্তী সময়ে মুসলিমরা অন্য বিষয়াদির মতো এ বিষয়েও অমনোযোগিতার কারণে ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ে। এমনকি এখন তো এ বিষয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের যে বিশাল অবদান তা আমরাই ভুলে বসেছি। অনেকের মিথ্যা প্রপাগান্ডায় আমরাও আমাদের কৃতিপুরুষদের কৃতিত্বে সন্দেহ পোষণ করছি।
জ্যোতির্বিজ্ঞান অর্জনে সাহাবা-তাবেঈনের নির্দেশনা
শরিয়তের সীমা-রেখা ঠিক রেখে জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে উপকৃত হওয়ার এবং এর যথোপযুক্ত ব্যবহারের নির্দেশনা সাহাবা-তাবেঈনের থেকেও পাওয়া যায়। খলিফা উমর (রা.) বলেন, ‘তোমরা জ্যোতির্বিদ্যা থেকে ওই অংশ শেখো, যার দ্বারা তোমরা কিবলা ও পথ নির্ণয় করতে পার। ’ (মাসাইলু হরব ইবনে ইসমাঈল, সালাত অধ্যায়: হাদিস ১৩০৮, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: হাদিস ২৫৬৪৯)
বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান
আমরা বৈজ্ঞানিক সঠিক তথ্যসমূহ থেকে উপকৃত হবো, তবে বৈজ্ঞানিক সব তথ্যকেই কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণের প্রয়োজন নেই। কেননা কোরআন-হাদিস মানুষের হিদায়াতের জন্য পৃথিবীতে এসেছে। কোরআন কোনো বিজ্ঞানের বই নয়। কারণ বিজ্ঞানের তথ্য তো মানুষের প্রচেষ্টা ও গবেষণার মাধ্যমেই অর্জন হতে পারে। এসব তথ্য অর্জনের জন্য অহির নির্দেশনার প্রয়োজন নেই। অহির নির্দেশনা তো এমন জিনিসের জন্য এসেছে, যা অহি ছাড়া অর্জন করা মানুষের সাধ্যে ছিল না। তাই কোরআন থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্য তালাশ করা বোকামি ও গোমরাহি। হ্যাঁ, কোরআনে কারিমে মহাপ্রজ্ঞাবান আল্লাহর কথা থেকে কোনো বর্ণনাপ্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বা ইঙ্গিতে বিজ্ঞানের কোনো তথ্য প্রমাণিত হতে পারে, যা নিঃসন্দেহে সঠিক তথ্য। সেগুলোর সঙ্গে বিজ্ঞানের সঠিক তথ্যের কখনো সংঘর্ষ হতে পারে না।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, বৈজ্ঞানিক তথ্যসমূহের মধ্যে কিছু তো এমন রয়েছে, যা চাক্ষুসভাবে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত ও দ্ব্যর্থহীনভাবে সঠিক হিসেবে প্রমাণিত। আর অনেক তথ্য এমন আছে, যেগুলো অবিসংবাদিত নয়; বরং ধারণাপ্রসূত, সন্দেহজনক ও গবেষণার যোগ্য। বিজ্ঞানের তথ্যসমূহ যেহেতু গবেষণানির্ভর, তাই তা নিত্য পরিবর্তনশীলও। পূর্বের অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য বর্তমানে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তদ্রুপ বর্তমানের কোনো তথ্য ভবিষ্যতে ভুল প্রমাণিত না হওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই কোরআন-হাদিসে বর্ণিত তথ্যাবলিকে দুমড়েমুচড়ে হলেও বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা করা কোরআনের ব্যাখ্যার নীতিসম্মত নয়। বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য শুধু চূড়ান্ত ও দ্ব্যর্থহীন কিংবা চাক্ষুসভাবে সঠিক প্রমাণিত হলেই সে আলোকে কোরআনের ব্যাখ্যা করা যায়। আর বলাবাহুল্য, চূড়ান্ত ও দ্ব্যর্থহীন কিংবা চাক্ষুসভাবে প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্যই কোরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় না। আজ পর্যন্ত হয়ওনি, কখনো হবেও না। কারণ কোরআন-হাদিসের বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন সত্য। আর সত্যে সত্যে কখনো সংঘর্ষ হতে পারে না। (আলইন্তিবাহাতুল মুফিদা, থানবি, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৯)
জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার উদ্দেশ্য
জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার উদ্দেশ্যে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অমুসলিমদের মতে তো শুধু জগতের অজানা জিনিসের উদঘাটন ও তা থেকে উপকৃত হওয়াই মূল উদ্দেশ্য। তবে মুসলিমদের কাছে সৃষ্টিজগৎ থেকে বৈষয়িকভাবে উপকৃত হওয়া যদিও একটি ইহলৌকিক প্রয়োজনীয়তা, তবে তা মূল উদ্দেশ্য নয়। তাই মুসলিমদের মূল উদ্দেশ্য হলো, সৃষ্টিজগতের রহস্য নিয়ে গবেষণা করে স্রষ্টার পরিচয় লাভ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা কি তাদের ওপর আসমানের দিকে তাকায় না, কিভাবে আমি তা বানিয়েছি এবং তা সুশোভিত করেছি? আর তাতে কোনো ফাটল নেই। আর আমি জমিনকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে প্রত্যেক প্রকারের সুদৃশ্য উদ্ভিদ উদগত করেছি। আল্লাহ অভিমুখী প্রতিটি বান্দার জন্য জ্ঞান ও উপদেশ হিসেবে। ’ (সুরা কফ, আয়াত : ৬-৮)
অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে, সে নৌকায় যা সমুদ্রে মানুষের জন্য কল্যাণকর বস্তু নিয়ে চলে এবং আসমান থেকে আল্লাহ যে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন অতঃপর তার মাধ্যমে মরে যাওয়ার পর জমিনকে জীবিত করেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার বিচরণশীল প্রাণী ও বাতাসের পরিবর্তনে এবং আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানে নিয়োজিত মেঘমালায় আছে নিদর্শন এমন দলের জন্য, যারা বিবেকবান। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৬৪)
আয়াতটি সম্বন্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই আয়াত তিলাওয়াত করল, কিন্তু তাতে চিন্তা-ফিকির করল না তার জন্য আফসোস!’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৬২০)
এ ছাড়া কোরআনে কারিমের অনেক আয়াতে আসমান-জমিন ও এতদুভয়ের মাঝে বিদ্যমান আল্লাহর কুদরত নিয়ে চিন্তা-ফিকিরের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কেননা এর মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টির লাখো-কোটি অপার রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়ে থাকে। এ জন্যই তাফসিরবিদ রাজি (রহ.) আল্লাহর পরিচয় লাভে জ্যোতির্বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের সমালোচনা করেন। (দেখুন: তাফসিরে কাবির ১৪/২৭৪)
তা ছাড়া শরিয়তের অনেক বিধানাবলি বুঝতে ও পালন করতে এ বিদ্যা শুধু সহযোগীই নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষ জরুরিও বটে।
একটি ভুলধারণার নিরসন
অনেকে ভুলবশত জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। জ্যোতিষশাস্ত্র হলো, তারকারাজির মাধ্যমে জগতের ভাগ্য নির্ণয় ও গায়েবি কথা বলা। জ্যোতিষশাস্ত্র শরিয়তে হারাম ও শিরকের অন্তর্ভুক্ত। আর জ্যোতির্বিজ্ঞান হচ্ছে, প্রত্যক্ষ ও যান্ত্রিক পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে মহাশূন্যের গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদিতে গবেষণা ও রহস্য উদ্ঘাটন করা। তা একটি বৈধ জ্ঞান। (মাআলিমুস সুনান ৪/২৩০)