ইসলামি ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জ্ঞানে-গুণে, ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল। দ্বাদশ শতাব্দীতে যখন সমগ্র ইসলামি বিশ্ব তাতারিদের ফিতনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল, তখনো নিরাপদে ছিল এই উপমহাদেশ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মজলুম জনগোষ্ঠী, আলিম, ইসলাম প্রচারক ও বুজুর্গরা আশ্রয় নিয়েছিল এই ভূখণ্ডে।
উসমানী খিলাফত যখন ভেঙে পড়ছিল তখনো সর্বপ্রথম খিলাফত পুনরুদ্ধারের ডাক এসেছে এই উপমহাদেশ থেকে। এজন্যই আবুল হাসান আলী নদভী ‘তারিখ-ই দাওয়াত ওয়া আযিমাত’ গ্রন্থে বলেন, মুসলিম বিশ্বের জন্য ভারতবর্ষের আবিষ্কার ও প্রাপ্তি একটি নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
হুসাইন আহমদ মাদানি তাঁর ‘হামারা হিন্দুস্তান আওর উসকে ফাজায়েল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, মক্কার পর ভারত মুসলমানদের দ্বিতীয় পবিত্র স্থান।
ইসলামের আগমনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে সাম্য-সম্প্রীতি, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সুখ-শান্তিতে ভরে ওঠে এই রাজ্য।
সমৃদ্ধির এই যাত্রা কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়।
ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবের সম্পর্ক
ভারতের ধন-ঐশ্বর্যের প্রতি সর্বকালেই পৃথিবীব্যাপী আকর্ষণ ছিল।
ইসলামের অভ্যুদয়ের অনেক আগে থেকেই বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আরব বণিকরা ভারতে আসতেন। সুতরাং ভারতে আসার পথ আরবদের জানাই ছিল। সেই সূত্রে আরব বণিকদের মাধ্যমেই এ দেশে প্রথম ইসলাম আসে। অতঃপর যখন উমাইয়া যুগে পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন ভারতও সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয়।
মুহাম্মাদ বিন কাসিম (৭১২ খ্রি.)
হিজরি প্রথম শতাব্দীতেই এখানে ইসলামের উৎসাহদীপ্ত কাফেলার আগমন ঘটে। তারপর ৯৩ হিজরিতে উমাইয়া গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশে তরুণ সিপাহসালার মুহাম্মাদ বিন কাসিম এ দেশের নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং সিন্ধুদেশ জয় করেন। এরপর মুলতানসহ পাঞ্জাবের দক্ষিণ অংশ মুসলমানদের অধিকারে আসে। মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করে সেখানে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। নাগরিকদের যার যার ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দেন। বহু হিন্দুকে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করেন। এ বিজয়ের সূত্র ধরে অনেক আরব সিন্ধু ও এর আশপাশে বসবাস করতে থাকে। এভাবে ভারতবর্ষে ইসলামের আত্তীকরণ শুরু হয়।
ভারত বিজয় (৯৯৮-১০৩০ খ্রি.)
ভারতবর্ষ বিজয়ের পুরো কৃতিত্বের অধিকারী হচ্ছেন আলেকজান্ডারের মতো দুঃসাহসী ইসলামের বীর সৈনিক সুলতান মাহমুদ গজনভি। সিন্ধু জয়ের প্রায় তিন শ বছর পর তিনি আবার ভারত অভিযান চালান। তিনি ছিলেন গজনির অধিপতি সবুক্তগিনের পুত্র। দশম শতাব্দীতে তিনি পাঞ্জাবকে গজনি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ১০০০ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ১৭ বার এই উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে অভিযান পরিচালনা করেন।
ইসলামি সাম্রাজ্য স্থাপন
ভারতবর্ষে সুদৃঢ় ও স্থায়ী ভিত্তিতে ইসলামি সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনের কৃতিত্বের অধিকারী হচ্ছেন সুলতান সিহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘোরী। সুলতান মাহমুদ গজনভির পর তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে রাজত্ব স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন।
মুহাম্মাদ ঘোরী ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দে মুলতান ও সিন্ধুর কিছু অংশ দখল করে ভারতে প্রবেশের পথ সুগম করেন। পেশোয়ার তাঁর দখলে আসে ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে। এরপর আস্তে আস্তে সিন্ধু ও পাঞ্জাব তাঁর অধিকারে আসে। তবে তিনি ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত হন। পরে শক্তি বৃদ্ধি করে আবার তিনি ভারতে অভিযান করেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ ও তার বন্ধু রাজ্যগুলো পরাজিত হয়। এভাবে মুহাম্মাদ ঘোরী ভারতে আফগান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করেন।
১২০৩ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসুদ্দিন মুহাম্মাদ ঘোরী মারা গেলে ঘোর ও ভারতের পুরো ক্ষমতা আসে সিহাবুদ্দিন মুহাম্মাদ ঘোরীর হাতে। সুলতান হিসেবে তাঁর নাম হয় মুইজুদ্দিন মুহাম্মাদ ঘোরী।
সুফি সাধকদের আত্মত্যাগ
দ্বাদশ শতাব্দীর তাতার ফিতনার পরিণতিতে ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রখ্যাত আলিম, শিক্ষক, বুজুর্গ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ভারতবর্ষে হিজরত করতে বাধ্য হন। তাঁরা এ দেশে এসে শিক্ষকতা ও ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে এ দেশের পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম। ভারতবর্ষে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও ঈমানি বিজয় প্রতিষ্ঠার মূল স্থপতি হলেন শাইখুল ইসলাম খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) (জন্ম ৬২৭ হি.), যাঁর রুহানি স্পর্শে লাখো হৃদয় ঈমানি আলোয় উদ্দীপ্ত হয়েছে।