হামিদ-উজ-জামান: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে বাংলাদেশে ৮০টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ১৭টি লক্ষ্যের ১০টিতেই করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সাম্প্রতিক অগ্রগতি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যান্য চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি কোভিড-১৯ টেকসই উন্নয়ন ধারণার মূল ভিত্তিগুলোর জন্য একটি বড় আঘাত। বিশেষ করে অন্তর্ভুক্তি ও কাউকে পেছনে ফেলে নয়-এ ধারণার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হয়েছে। এই কোভিডে আর্থ-সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। সৌভাগ্যক্রমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রাণহানি কম হলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে মন্থর হয়েছে।
এর প্রভাবে রপ্তানি আয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। পাশাপাশি বিনিয়োগ এবং রাজস্ব আয়ও হ্রাস পায়। এতসব ধাক্কা সামলিয়ে আগামী ৮ বছরে এসডিজির বাস্তবায়ন কতটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেওয়া যাবে তা নিয়ে রয়েছে নানা সংশয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, করোনা মহামারির কারণে শুধু আমরা নই, পুরো বিশ্বই পিছিয়ে গেছে। তবে করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসব ঘটনা না ঘটলে আমরা হয়তো অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। এরপরও থেমে নেই সরকার। নানারকম কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে করোনা ও যুদ্ধের ক্ষত সারাবার প্রচেষ্টা চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতিসংঘ এসডিজির মেয়াদ ২০৩০ সালের পর হয়তো আর বাড়াবে না।
তখন নতুন নামে নতুন উন্নয়ন এজেন্ডা হয়তো আসবে। তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্য নিরসন, জেন্ডার সমতা অর্জন, গ্রামীণ রূপান্তর প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্প্রসারণ এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন প্রশংসীয়। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৭টি অভীষ্টের (লক্ষ্য) মধ্যে দারিদ্র্যে বিলোপের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে ছয়টি, ক্ষুধামুক্তিতে ছয়টি, সুস্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণে তিনটি এবং গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঁচটি। এছাড়া জেন্ডার সমতায় নয়টি, নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনে চারটি, সাশ্রয়ী-নির্ভরযোগ্য-টেকসই ও আধুনিক জ্বালানির ক্ষেত্রে পাঁচটি, শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পাঁচটি এবং শিল্প-উদ্ভাবন ও অবকাঠামোয় প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে চারটি। আরও আছে অসমতা হ্রাসের ক্ষেত্রে দুটি, টেকসই নগর ও জনপদে ছয়টি এবং পরিমিত ভোগ ও উৎপাদনে তিনটি চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও জলবায়ু কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ছয়টি, জলজ জীবনের ক্ষেত্রে ছয়টি, স্থলজ জীবনে দুটি, শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পাঁচটি এবং অভীষ্ট অর্জনে অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে পাঁচটি।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আরও দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে কমে গিয়ে প্রকৃত অর্জন হয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল জিডিপির ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, অর্জন হয় ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ। রপ্তানির ক্ষেত্রে ৪৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। কর রাজস্বের ক্ষেত্রে ৩ হাজার ৪০১ বিলিয়ন টাকার বিপরীতের আয় হয়েছে দুই হাজার ২০৭ বিলিয়ন টাকা। বাজেট ঘাটতির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য থাকলেও সাড়ে ৫ শতাংশে গেছে। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য থাকলেও বেড়ে হয়েছিল ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। করোনা কারণে জিডিপির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।
রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৮ বিলিয়ন ডলারের। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। কর আদায়ে ক্ষতি হয় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদে বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও বৈষম্যও বেড়ে যায় করোনার প্রভাবে। তবে করোনার স্বল্পমেয়াদি প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ভালো ভূমিকা রেখেছে।
ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির অনেক সূচক পুনরুদ্ধার হতে শুরু করে। যেমন ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গিয়ে হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। পরবর্তীতে ২০২০-২১ অর্থবছরে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও বেড়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
করোনার প্রভাবে এসডিজির যেসব অভীষ্ট বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সেগুলো হলো, এসডিজি-১ (দারিদ্র্য বিলোপ), এসডিজি-২ (ক্ষুধামুক্তি), এসডিজি-৩ (সুস্বাস্থ্য ও সামাজিক সুস্থ্যতা), এসডিজি-৪ (মানসম্মত শিক্ষা), এসডিজি-৫ (জেন্ডার সমতা), এসডিজি-৬ ( সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন) এবং এসডিজি-৮ ( শোভন কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) আরও আছে এসডিজি-৯ (শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো), এসডিজি-১০ (বৈষম্য হ্রাসকরণ) এবং এসডিজি-১৩ (জলবায়ু কার্যক্রম)।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে এসডিজির গুরুত্বপূর্ণ অভীষ্টের ওপর অতিমারির প্রভাব বিভিন্ন পর্যায়ের ওপর নির্ভর করছে। কোভিডকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক মন্দা এসডিজির জন্য সম্ভাব্য অর্থায়ন ব্যবস্থাপকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। এসডিজি বাস্তবায়নে অর্থায়নের মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ। করোনাকালে এর সবগুলোতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ঘোষিত লকডাউনের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ফলে শিশুদের ন্যূনতম যে পঠন দক্ষতা থাকার কথা, এখন তা থেকে তারা অনেক নিচে অবস্থান করছে। এছাড়া করোনার সময় বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পায়, যা মেয়েদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। কোভিড-১৯ সমাজের অসমতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে, যা এসডিজি বাস্তবায়ন অগ্রগতিকে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পাশাপাশি করোনায় বর্ধিত বেকারত্বের হার ও বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্য চরমভাবে বেড়ে যায়।