গত ১৭ অক্টোবর ছিল ‘আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস’। এই দিবসে এই বার যাহা বলা হচ্ছে, তার মর্মার্থ হলো- যথাযোগ্য ভালো কাজ এবং সামাজিক সুরক্ষার ভিতর দিয়ে সকলের মধ্যে মর্যাদাবোধ জাগ্রত করা। আসলে গরিব মানুষের মেরুদণ্ড সোজা রাখার মতো সংগতি থাকে না। সেই কারণে দরিদ্র মানুষের মর্যাদাবোধও কম থাকে। কিন্তু সকলেই তো একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সকল মানুষেরই মাতৃজঠরে জন্ম হয়েছে এবং সকলেরই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। এজন্য বড় চণ্ডীদাস বলেছেন-সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘দারিদ্র্য’কে মহান করে একটি অপূর্ব কবিতা রচনা করেছিলেন। তিনি নিজে অত্যন্ত দারিদ্র্যপীড়িত পরিবেশে বড় হয়েছেন। ছোটোবেলায় তাকে ডাকা হতো দুখুমিয়া নামে। বিরল প্রতিভাধর এই কবি ‘দারিদ্র্য’কে এতটাই মহিমান্বিত করেছেন যে, তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন-দারিদ্র্য তাকে যিশু খ্রিষ্টের সম্মান দান করেছে। কেবল তাই নহে, দারিদ্র্য তাকে দিয়েছে ‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’। এই অবধি শুনতে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু তারপর কী হলো? কী বললেন তিনি? এই কবিতায় এক জায়গায় নজরুল বলেছেন-‘টলটল ধরণীর মত করুণায়!/ তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়/ করুণা-নীহার-বিন্দু হয়ে উঠি/ ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি।’ অর্থনৈতিক দুরবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলির স্বপ্নও তেমনি টুটে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশেষ একটি সমাবেশ। সেখানে জড়ো হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ। এর উদ্যোক্তা জোসেফ রেসিনস্কির মৃত্যুর পর ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ অক্টোবরকে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে মনোনীত করে। ১৭ অক্টোবরের স্মারক ফলক-যাহা ফাদার জোসেফ ১৯৮৭ সালে ট্রোকাডেরো প¬াজায় উন্মোচন করেছিলেন-তা আজ বিশ্বব্যাপী মানবতার প্রতীক হিসাবে স্বীকৃত। সেই ফলকে বলা হয়েছে-‘যেখানেই নারী-পুরুষের চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, সেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।’ কাজী নজরুল ইসলাম যেমন লিখেছেন-‘পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,/ দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে! মোর অধিকার/আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ/ পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ।’ দারিদ্র্যের ব্যাপারে বিখ্যাত কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি বলেছিলেন-‘আমি অনেক গরিব মানুষ দেখিয়াছি, যাহাদের শরীরে কোনো পোশাক নাই; আমি অনেক পোশাক দেখিয়াছি, যাহার ভিতরে কোনো মানুষ নাই।’
গরিবি দশা হতে নিজেকে মুক্ত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে ইসলাম ধর্মে। মহান আল্লাহ্ কাউকে করেছেন সম্পদশালী, আবার কাউকে করেছেন সম্পদহীন, দরিদ্র। ধনী-গরিবের এমন শ্রেণিভাগ একান্তই আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছাধীন। ধনী-গরিবের এই তারতম্যের পেছনে আল্লাহ্ তায়ালার উদ্দেশ্য হলো তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করা। আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন, ‘জেনে রেখো, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তানসন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর মহাপুরস্কার রয়েছে আল্লাহরই নিকট।’ (সুরা আনফাল ২৮)। তবে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক ধনী-গরিব শ্রেণির প্রভেদের অর্থ এই নহে যে, মানুষ অকর্মণ্য হয়ে ইচ্ছাকৃত দারিদ্র্য গ্রহণ করবে! বরং প্রতিটি গরিব মানুষকে বৈধ সীমারেখার ভিতরে জীবনের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। কারণ, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-‘দারিদ্র্য কখনো কখনো কুফরিতে নিমজ্জিত করে।’ (শুআবুল ইমান)। সুতরাং প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব রয়েছে নিজের আর্থিক উন্নতির জন্য জমিনে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক অনুসন্ধান করা। শারীরিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্যমুক্ত জীবন অর্জনের চেষ্টা করা।